প্রথমেই আমাদের পারাজিকা অর্থকথার এই উদ্ধৃতিটা মনে রাখা উচিত, যেখানে বলা হয়েছে, পব্বজিতপরিভোগো হি আগারিকানং চেতিযট্ঠানিযো। অর্থাৎ প্রব্রজিতের যেকোনোকিছু হচ্ছে গৃহীদের কাছে পূজনীয় জিনিস। আপনি শ্রদ্ধাভরে বুদ্ধকে সিয়ং দিলেন, সেটা বুদ্ধের জিনিস হয়ে গেল। পিতার সম্পত্তি যেমন পুত্রের অধিকারে, তেমনি সেই বুদ্ধসিয়ং এর উপর তখন একমাত্র অধিকার থাকবে ভিক্ষুসংঘের। একমাত্র ভিক্ষু অথবা শ্রামণ তা পরিভোগ করতে পারে। তাদের খাওয়ার পরে উচ্ছিষ্ট থাকলে সেগুলো যদি ভিক্ষুরা দেয়, তবেই খাওয়া উচিত। না দিলে খাওয়া উচিত নয়। তবে আপনি যদি মনে করেন, খেলে কী এমন হবে! সেগুলো তো এমনিতেই নষ্ট হয়ে যাবে, তাহলে আমার বলার কিছু নেই।
তবে বুদ্ধ কিন্তু উদ্ধৃত্ত খাবার থাকলে সেগুলো লোকজনকে দিতে বলতেন। তাই উদ্ধৃত্ত খাবার থাকলে সেগুলো লোকজনকে দেয়া উচিত। কিন্তু ভিক্ষুদের অনুমতি না নিয়ে গৃহীদের খাওয়া উচিত নয়। কর্ম বড়ই জটিল জিনিস। সেগুলো খেয়ে মরার পরে নরকে জন্মানোর মত কর্ম করে কী লাভ? সেগুলো না খেলে কি জীবন চলবে না নাকি? ঐ মিতব্যয়ী হওয়ার মন্ত্র অন্তত এখানে খাটে না।
তবে বুদ্ধ কিন্তু উদ্ধৃত্ত খাবার থাকলে সেগুলো লোকজনকে দিতে বলতেন। তাই উদ্ধৃত্ত খাবার থাকলে সেগুলো লোকজনকে দেয়া উচিত। কিন্তু ভিক্ষুদের অনুমতি না নিয়ে গৃহীদের খাওয়া উচিত নয়। কর্ম বড়ই জটিল জিনিস। সেগুলো খেয়ে মরার পরে নরকে জন্মানোর মত কর্ম করে কী লাভ? সেগুলো না খেলে কি জীবন চলবে না নাকি? ঐ মিতব্যয়ী হওয়ার মন্ত্র অন্তত এখানে খাটে না।
কেন খাটে না? কারণ যার সম্পত্তি সে যেভাবে খুশি ব্যবহার করবে। বৌদ্ধধর্ম ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। যার যার কর্ম তার তার কাছে। যার যার সম্পত্তি তার তার কাছে। সে তার সম্পত্তি নিয়ে দান করবে নাকি যক্ষের মত আগলে রাখবে নাকি রংতামাশায় ব্যয় করবে সেটা তার ব্যাপার। ইলন মাস্ক ৪৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে টুইটার কিনছেন। লোকজন তাতে খুশিতে লাফাবে। কেন? এলন মাস্ক এত টাকা খরচ না করলে কি টুইটার মরে যাবে? তার সেটা দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে একটু সাহায্য করলেও তো হত। ইব্রাহিম মুসা লাখ লাখ টাকা খরচ করে এভারেস্টে উঠলেন। কেন? এত লাখ টাকা খরচ করতে হবে কেন? বাংলাদেশে কি গরীব মানুষের কমতি আছে? তাদেরকে দেন না কেন তিনি? কেউ কি এসবের প্রশ্ন তুলেছে?
যত প্রশ্ন আসে, শুধু সিয়ং কেন ফেলে দেয়া হয়, কোটি কোটি টাকায় কেন প্যাগোডা বানানো হয়, এই সব নিয়ে। এসব প্রশ্নের একটাই কারণ, সেটা হচ্ছে ঈর্ষা। অন্যের শ্রী ও সমৃদ্ধিতে ঈর্ষাকাতর হয়ে তারা এসব অদ্ভূত প্রশ্নের জন্ম দেয়। যেন তারা দুনিয়ায় সাম্যবাদীর একেকজন মূর্ত প্রতীক। অথচ সেই তথাকথিত সাম্যবাদ যে অলীক অবাস্তব অসম্ভব একটা আইডিয়া, সেটা তারা জানে না। তারা জানে না, দুনিয়ার লোকজন হচ্ছে নানাত্ম সংজ্ঞী। অর্থাৎ এই দুনিয়ার সব মানুষের ধ্যানধারণা, রুচি, মনোভাব, পছন্দ অপছন্দ কখনোই এক নয়। অথচ এই সাম্যবাদীরা তাদের ভ্রান্ত ধারণাগুলো অন্যের উপরে জোর করে চাপিয়ে দিতে চায় এসব প্রশ্নের মাধ্যমে। জোর করে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যেখানে লোকজনের পছন্দ অপছন্দ কখনোই সমান নয়, সেখানে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করা বাতুলতা নয় কি?
সাম্যবাদের জনক কার্ল মাক্স বলে দিলেন ধর্ম হচ্ছে আফিম। আমি তো বলি, তার সেই সাম্যবাদই হচ্ছে আফিম। যার নেশায় বু্ঁদ হয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ বিপ্লব করে মারা গেছে, মরছে, আরো মরবে। কারণ কী? খেলাফত প্রতিষ্ঠার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে মগজ ধোলাই হয়ে ঐ গোবেচারা জিহাদীরা যেভাবে আত্মাহুতি দেয়, সেভাবেই বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত অবুঝ লোকজন নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে মশা মাছির মতো মারা যায়। কিন্তু আলটিমেটলি হয় কী? যেই লাউ সেই কদু। আগে যেরকম ধনী গরীবের বৈষম্য, পরেও সেরকম। রাশিয়া, চীন আর লাতিন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে এখন ধনী গরীবের কী বৈষম্য তা দেখলেই তো বুঝা যায়। কার্ল মাক্সের তো এখন কফিন থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসার কথা।
আর কেউ যদি সমাজতন্ত্র আর সাম্যবাদ এক নয় বলে তর্ক করতে এগিয়ে আসেন তাহলে আমি নিজেকে অতদূর নিচে নামাব না। যার যা খুশি নিজের প্রোফাইল থেকে লিখুন গিয়ে।
বলা বাহুল্য, বৌদ্ধধর্মে সাম্যবাদের স্থান নেই। ঐ রাহুল সাংকৃত্যায়নের বুলিতে আর যেই ভুলুক, আমি ভুলি না। বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে কর্মবাদী ধর্ম। কর্ম সবকিছুর নিয়ন্তা। আর দুজনের কর্ম কখনোই এক হয় না। তাই সেখানে সাম্যের প্রশ্নই আসে না। একারণেই তো বুদ্ধ যেখানে ধনী গরীবের বৈষম্যের জন্য যার যার পূর্বকৃত কর্মকেই দায়ী করেছেন, সেখানে সাম্যবাদীরা দায়ী করে শাসকগোষ্ঠীর শাসন শোষণকে। তা থেকে হয় শ্রেণিসংঘাত। সেই সংঘাতে প্রাণ হারায় মিলিয়ন মিলিয়ন জনতা। অথচ যে সাম্যবাদের আদর্শে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিজম, সেই কমিউনিজমের দেশ চীন রাশিয়ায় ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে, গরীবেরা থেকে যাচ্ছে গরীব। কোথায় গেল কার্ল মাক্সের স্বপ্ন? সাম্যবাদের দেশে যদি এই অবস্থা হয় তাহলে পুঁজিবাদের দেশ আমেরিকা ইউরোপে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
দুঃখিত, কোত্থেকে কোথায় চলে যাচ্ছি। বলছিলাম সিয়ং ফেলে দেয়ার কথা। যেমন বিনয়পিটকের মহাবর্গে (মহাৰ.২৮৪) বেলট্ঠ কচ্চায়নের কথা আছে, যে বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে এক হাঁড়ি গুড় দান করেছিল। কিন্তু সাড়ে বারশ ভিক্ষুকে দিয়েও এক হাঁড়ি গুড় ফুরালো না। কেন ফুরালো না তা আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না। কিন্তু এতগুলো গুড়ের কী হবে? সেগুলো ইতিমধ্যেই বুদ্ধকে দান করা হয়েছে। তাই সেগুলো অন্য কারো খাওয়ার জিনিসও নয়।
তখন বুদ্ধ সেগুলো উচ্ছিষ্টভোজীর দলকে দিতে বললেন। কিন্তু তাদেরকে দিয়েও সেই গুড় ফুরাল না। তখন বুদ্ধ বললেন, এই দুনিয়ায় এই গুড় খেয়ে হজম করতে পারবে এমন কেউ নেই, একমাত্র তথাগত অথবা তার শিষ্যরা ছাড়া। তিনি সেগুলো গভীর পানিতে ফেলে দিতে বললেন, অথবা তৃণহীন মাটিতে ফেলে দিতে বললেন।
এখানে খটকা লাগার অনেক কিছু আছে। সবচেয়ে যেটা খটকার বিষয় আমার কাছে, তা হচ্ছে, সেই গুড় অন্যরা খেয়ে হজম করতে পারবে না কেন? হজম করতে না পারলে গরীব উচ্ছিষ্টভোজীদেরকে দেয়া হলো কেন? তারা কীভাবে হজম করবে? তারা তো বুদ্ধের শিষ্য না। খাবারের লোভে বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘের পিছে পিছে ঘুরে বেড়ায় মাত্র। তাদের বেলায় এই ব্যতিক্রম কেন?
আমার বৃহত্তর জ্ঞানে (!) অনুমান হয়, তারা বুদ্ধের শিষ্য না হয়েও সেই গুড় হজম করতে পেরেছিল, কারণ বুদ্ধ তাদেরকে সেগুলো দেয়ার অনুমোদন করেছিলেন। বুদ্ধ অনুমোদন না করলে সেগুলো তাদের হজম করার প্রশ্নই আসত না। কারণ তাহলে তো অন্য কেউ হজম করতে পারবে না বলে বুদ্ধের যে দাবি, সেটা মিথ্যা হত।
একারণেই যেসব জিনিস গছানো হয়েছে, সেগুলো ভিক্ষুদের খাওয়ার পরেও উচ্ছিষ্ট থাকলে তা খাওয়া উচিত নয়। ভিক্ষুসংঘ যদি অনুমতি দেয়, তবেই খাওয়া উচিত। নাহলে বদহজম হতে পারে!
আবার ধর্মপদ অর্থকথায় কোসিয় শ্রেষ্ঠির কাহিনী আছে। সে ও তার স্ত্রী পিঠা দিয়ে বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে পরিবেশন করেছিল। কিন্তু তবু পিঠা ফুরাল না। শ্রেষ্ঠি এবং তার স্ত্রীও পেটপুরে খেল। সারা বিহারে উচ্ছিষ্টভোজীদেরকেও দেয়া হলো। এরপর বুদ্ধ সেটা ফেলে দিতে বললেন। সেটা জেতবনের পাশের একটা খাদে ফেলে দেয়া হলো।
তাই বুদ্ধকে সিয়ং দেয়ার পরে সেটা ভিক্ষু শ্রামণরা খেতে পারে। কিন্তু গৃহীর সেগুলো খাওয়া উচিত নয়। বুদ্ধের নির্দেশ মত সেই সিয়ং কোনো পরিষ্কার জায়গায় ফেলে দেয়া উচিত। অথবা গভীর পানিতে ফেলে দেয়া উচিত।
তাহলে সিয়ং উচ্ছিষ্ট হলে কী করা যায়? সেগুলো অবশ্যই বিহারে থাকা সেবক ও অন্যান্য লোকজনকে দেয়া উচিত। বুদ্ধ যেমন খাবার উদ্ধৃত্ত হলে উচ্ছিষ্টভোজীদেরকে দিতে বলতেন।
প্রব্রজিতের ব্যবহার্য জিনিস হচ্ছে গৃহীদের জন্য পূজনীয়। সেটাকে অবহেলা করলে পাপকর্ম কুড়াবেন। আবার সেটা মনে রেখে উপযুক্ত শ্রদ্ধা দেখালে পুণ্য পাবেন। এটা সবার মনে রাখা উচিত।