আপনাদের কি শশপণ্ডিত জাতকের কথা মনে আছে? আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমাদের গৌতম বুদ্ধ আগের কোনো এক জন্মে খরগোশ হিসেবে জন্মেছিলেন। তার বন্ধু হিসেবে ছিল এক বানর, এক শেয়াল, ও এক ভোঁদড়। কথায় আছে না, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। তাই খরগোশ হিসেবে জন্মালেও বোধিসত্ত্ব স্বভাবতই তার তিন বন্ধুকে উপদেশ দিতেন, দান দেয়া উচিত, শীল রক্ষা করা উচিত, উপোসথ পালন করা উচিত। তাই তাকে ডাকা হতো শশপণ্ডিত নামে।
একবার এক পূর্ণিমার দিনে সবাই সকালে খাবার খুঁজতে বের হল। ভোঁদড় খুঁজে আনল মাছ। শেয়াল খুঁজে আনল মাংস। বানর খুঁজে আনল পাকা আম। কিন্তু সেদিন পূর্ণিমা উপোসথের দিন হওয়ায় তারা সেগুলো উপোসথের সময় শেষ হলে খাবে বলে ঠিক করল। এদিকে শশপণ্ডিত কোথাও বের হল না। সে শুধু চিন্তা করছিল, আমার কাছে তো চালডাল বা অন্য কোনো খাবারদাবার নেই। আমি খাই শুধু ঘাস। কিন্তু কেউ যদি ভিক্ষা চাইতে আসে, তাকে তো আর ঘাস দেয়া যায় না। তাহলে কী করি? ঠিক আছে। কেউ যদি কোনো কিছু চাইতে আসে, তাহলে নিজের শরীরের মাংস দিয়ে দেব।
দেবতাদের রাজা ইন্দ্র জানতে পারলেন তার সংকল্পের কথা। তিনি শশপণ্ডিতকে পরীক্ষা করার জন্য নেমে এলেন পৃথিবীতে। কিন্তু তার আগে ব্রাহ্মণের বেশে ভিক্ষা চাইতে গেলেন অন্য তিন বন্ধুর কাছে। তখন ভোঁদড় তাকে মাছ দিতে চাইল। শেয়াল দিতে চাইল মাংস। বানর দিতে চাইল পাকা আমগুলো। শেষে ইন্দ্ররাজা গেলেন খরগোশটার কাছে। শশপণ্ডিতের কাছে দান দেয়ার মতো কিছু নেই। তাই সে নিজের শরীরকেই খাবার হিসেবে দান করে দিল। ইন্দ্ররাজা একটা আগুন জ্বাললেন। খরগোশ নির্দ্বিধায় সেই অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিল। তবে দেবরাজের আগুন বলে কথা। তাই সেই আগুনে সে পুড়ে গেল না।
এদিকে তার এমন দুঃসাহসিক কাজে মুগ্ধ হয়ে গেলেন দেবরাজ ইন্দ্র। তিনি ভাবলেন চাঁদের বুকে এই খরগোশের একটা ছবি এঁকে দিলে কেমন হয়! তিনি আস্ত একটা পর্বতকে পিষে রস বের করে নিলেন। সেই পর্বতের রস দিয়ে চাঁদের বুকে এঁকে দিলেন খরগোশের ছবি। খরগোশের এমন গুণের কথা স্থায়ী হয়ে থাকুক পৃথিবীর শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত।
এই হচ্ছে আমাদের বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী। বৌদ্ধরা সাধারণত এটাই বিশ্বাস করে থাকে। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের লোকজন কী মনে করে? আমি একটু গুগলে সার্চ দিলাম। চাঁদের বুকে খরগোশের ছবি নিয়ে বিভিন্ন দেশের লোকজন বিভিন্ন কাহিনী বিশ্বাস করে থাকে। দেখলাম জাপানে খুব বিখ্যাত হয়ে আছে এই জাতকের কাহিনীটা। কোরিয়া এবং ভিয়েতনামেও ঐ একই কাহিনী ঢুকে গেছে তাদের সংস্কৃতিতে। তবে অবাক লেগেছে এজটেকদের কাহিনী জেনে।
আমেরিকার মেক্সিকোতে পাঁচশ বছর আগেও এজটেক (Aztecs) নামের জাতি বসবাস করত। তারা ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তারা গড়ে তুলেছিল বিশাল এজটেক সাম্রাজ্য। তাদের দেবতা ছিল কোয়েযাল কুআটল (Quetzalcoatl)। তাদের এই দেবতা কোয়েযালকুআটল নাকি একবার পৃথিবীতে মানুষ রূপে নেমে এসেছিল। হাঁটতে হাঁটতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। অথচ আশেপাশে খাদ্য বা পানীয় বলতে কিছু নেই। পাশেই চরছিল একটা খরগোশ। লোকটির দুরবস্থা দেখে খরগোশ তখন নিজের শরীরকে খাদ্য হিসেবে দান করার প্রস্তাব দিল। খরগোশের আত্মোৎসর্গের প্রস্তাবে কোয়েযালকুআটল এত অবাক হয়ে গেল যে বলার মতো নয়। তখন সে খরগোশটাকে চাঁদে নিয়ে গেল, তারপর আবার পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে বলল, ‘তুমি তো একটা খরগোশ মাত্র। কিন্তু তোমার কথা প্রত্যেকে স্মরণ করবে। সারা পৃথিবীর লোকজন চাঁদের আলোয় তোমার ছবিকে দেখবে সবসময়।’
কাহিনীটা পড়ে আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। জাতকের কাহিনীর সাথে এত মিল হলো কীভাবে? সেই একই ধাঁচে দেবতার স্বর্গ থেকে নেমে আসা, একইভাবে খরগোশের নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়া! তারা কোত্থেকে পেলো এই কাহিনী? চীন, জাপান, কোরিয়া ইত্যাদির কথা না হয় বাদ দিলাম কিন্তু মেক্সিকোতে এই কাহিনী গেল কী করে? সেটাও স্প্যানিশদের আক্রমণের অনেক আগে? বৌদ্ধধর্ম কি তাহলে বহু শত বছর আগেই আমেরিকার মাটিতে পা দিয়েছিল?
আরেকটা অবাক করা বিষয় হচ্ছে, চীন, জাপান, কোরিয়া ইত্যাদি দেশে শীতকালের মাঝামাঝিতে একটা উৎসব হয়, সেটাও এই চাঁদের বুকে থাকা খরগোশকে নিয়ে। অথচ বাংলা সাহিত্যে চাঁদের বুকে থাকা খরগোশকে নিয়ে সেরকম কোনো কাহিনী খুঁজে পাই নি আমি। বাংলা সাহিত্যে চাঁদের বুড়ির কথা আছে বটে, কিন্তু চাঁদের খরগোশকে নিয়ে কোনো গল্প নেই, কবিতা নেই, কাহিনী নেই। এমনকি হিন্দুধর্মেও খুঁজে পাই নি। আর ইসলামে তো নেইই। তাই আমার মনে হয় সেটা কেবল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে খুব প্রচলিত। এ থেকে ধরে নেয়া যায়, আমেরিকার সেই এজটেক জাতির লোকেরা চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতাব্দীর আগেও বৌদ্ধধর্মের সাথে পরিচিত ছিল।
সে যাই হোক, সারা দিনভর ঘাঁটাঘাঁটির ফলে অবশেষে বুঝতে পারলাম যে, পৃথিবীতে চাঁদের বুকে খরগোশের ছবি নিয়ে যতসব কাহিনী আছে তার মধ্যে বেশিরভাগেরই আদি উৎস হচ্ছে বুদ্ধের এই জাতকের কাহিনী। বুদ্ধ যদি এটা না বলতেন তাহলে এই কাহিনীও ছড়িয়ে পড়ত না সবার মাঝে। এভাবে পৃথিবীর লোকজন বুদ্ধের কাছে কত ঋণী তা তারা নিজেরাও জানে না।
শান্তি পেলাম জেনে।
হ্যাঁ ভান্তে। খুঁজে দেখা দরকার।
বন্দনা ভান্তে,খুব ভালো লাগলো আপনা লেখনিটি, নিঃসন্দেহে এজটেক সভ্যতার খরগোশের গল্পটি বুদ্ধ জাতক থেকে সংগ্রহ করা। আর আমি অভাক না হয়ে পারছিনা, বাংলা সাহিত্যের মতো চাকমা সাহিত্যে খরগোশ নিয়ে কোন গল্প নেই। কিন্তু ঠিকই বাংলা সাহিত্যের মতো চাঁদের বুড়ি নিয়ে গল্প প্রচল আছে।আসলে চাকমাদের সংস্কৃতি এমন তো হবার নয়?
ভালো কথা বলেছেন। চাকমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসটা আরেকটু ভালো করে খুঁজে দেখা দরকার।