থেরবাদা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের বৌদ্ধধর্মের উপরে ডিপ্লোমা ক্লাস শুরু হয়েছে। প্রথম ক্লাসটা ছিল সুত্রপিটক। শুরুতেই একটা করে লেকচার শীট ধরিয়ে দেয়া হলো সবাইকে। দেখলাম সব্রহ্মক সুত্রের ছোট্ট এক পেজের ইংরেজি অনুবাদ। এর আগে কখনো এই সুত্রের কথা শুনেছি বলে মনে পড়ে না। কৌতুহলী হয়ে একটু পড়ে দেখলাম। মাতাপিতাকে সেবাপূজা করার সুফলের কথা বর্ণনা করা হয়েছে সুত্রটিতে।
কিন্তু শুধু অনুবাদ পড়ে আমার মন ভিজল না। অর্থকথায় কী আছে সেটাও দেখা দরকার। তাই রুমে এসে কম্পিউটারে খুঁজে বের করলাম সুত্রটাকে। পালি দেখলাম, অর্থকথা দেখলাম। অর্থকথার দুটো ব্যাখ্যা খুব পছন্দ হলো আমার। ভাবলাম বাংলাদেশের দুয়েকজন পাঠক আছেন যারা আমার লেখা পছন্দ করেন। তাদের জন্য হলেও অন্তত একটা কিছু লেখা দরকার এব্যাপারে। ধর্মদান হবে। ধর্মদান নাকি সকল দানের সেরা। তাই লিখতে বসলাম।
সুত্রটিতে বুদ্ধ বলেছেন যে, যেসব পরিবারে মা-বাবা সন্তানদের কাছ থেকে সেবাযত্ন ও সুরক্ষা পেয়ে থাকেন সেই পরিবার যেন ব্রহ্মাদের সাথে বসবাস করে। সেই পরিবার যেন আদি শিক্ষাগুরুদের সাথে বসবাস করে। সেই পরিবার যেন উপহার গ্রহণের যোগ্য পাত্রদের সাথে বসবাস করে। তার কারণ কী? মা-বাবা হচ্ছেন সন্তানদের বহু উপকারী, রক্ষাকারী ও ভরণপোষণকারী, জগত প্রদর্শক।
“জগত প্রদর্শক” কথাটা বেশি কঠিন হয়ে গেল। অর্থকথা বলছে, শিশুরা সাধারণত ছোটবেলা থেকে পরিবারে বাবা-মায়ের কাছে বেড়ে ওঠে। সেকারণে এই জগতে ভালোমন্দ বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের যে একটা দৃষ্টিভঙ্গি জাগে সেটা মূলত তাদের বাবা-মায়ের উপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠে। তাই মা-বাবা হন সন্তানদের জন্য জগত প্রদর্শক।
পরিবারে মা-বাবা হলেন ব্রহ্মা এবং আদি শিক্ষাগুরু। বাবা-মা কীভাবে ব্রহ্মা হন? অর্থকথা বলছে, ব্রহ্মাগণ হলেন গিয়ে খুব উচ্চস্তরের দেবতা, যাদের মনে সবসময় মৈত্রীচিন্তা বিরাজ করে, করুণার চিন্তা বিরাজ করে, অপরের সুখে সুখীভাব বিরাজ করে অথবা উপেক্ষাভাব বিরাজ করে। ঠিক তেমনিভাবে বাবা-মায়ের মনেও তাদের সন্তানের প্রতি এই চারটি ভাব বিরাজ করে সবসময়। উদাহরণস্বরূপ, গর্ভস্থ সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের মনে মৈত্রীভাব জাগে এভাবে, “আমাদের সন্তান নিরোগী ও পরিপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্মাক।” ছোটবেলায় পোকামাকড়ের কামড় খেয়ে ব্যথায় কেঁদে উঠলে তা শুনে বাবা-মায়ের মনে করুণা জাগে। এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে খেলা করার সময়ে, অথবা তরুণ বয়সে সন্তানকে দেখে বাবা-মায়ের মন খুশিতে আমোদিত হয়। আবার সন্তান যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে স্ত্রীপুত্রের ভরণপোষণ করে নিরাপদে জীবনযাপন করে, তখন বাবা-মায়ের মনে উপেক্ষা ভাব জাগে এভাবে, ‘আমাদের সন্তান এখন নিজেনিজে চলতে পারে।’ এভাবে সন্তানের প্রতি স্নেহমমতার দিক দিয়ে মা-বাবা হচ্ছেন ব্রহ্মার সমতুল্য।
আবার মা-বাবা কীভাবে সন্তানের আদি শিক্ষাগুরু হন? জন্ম থেকে শুরু করে মা-বাবা তাদের সন্তানকে প্রথম শিক্ষা দেন এভাবে, ‘এভাবে বস, এভাবে দাঁড়াও, এভাবে হাঁট, এভাবে শোও, এভাবে খাও, একে বাবা বলে ডাকবে, এ হচ্ছে তোমার ভাই, এ হচ্ছে তোমার বোন, এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত নয়, অমুকের সাথে মেশা উচিত, অমুকের সাথে মেশা উচিত নয় ইত্যাদি।’ পরবর্তীতে অন্য শিক্ষাগুরুগণ তাকে শিক্ষা দেন কীভাবে হাতি চালনা করতে হয়, কীভাবে ঘোড়া চালনা করতে হয়, কীভাবে রথ চালনা করতে হয়, কীভাবে ধনুক দিয়ে তীর ছুঁড়তে হয়, কীভাবে গণনা করতে হয় ইত্যাদি। আবার প্রব্রজ্যা নেয়ার সময়েও একজন গুরু তাকে ত্রিশরণ দেন, অন্যজন শীল প্রদান করেন, অন্যজন প্রব্রজ্যা দেন, অন্যজন বুদ্ধবাণী শিক্ষা দেন, অন্যজন উপসম্পদা বা ভিক্ষুত্বে বরণ করেন, আবার অন্যজন তাকে স্রোতাপত্তি ইত্যাদি মার্গফলে উপনীত করান। এভাবে এরা সবাই তখন তার পরবর্তী শিক্ষাগুরু হয়ে থাকেন। মা-বাবা কিন্তু তাকে সর্বপ্রথম শিক্ষা দিয়ে থাকেন। একারণেই মা-বাবাকে আদি শিক্ষাগুরু বলেছেন বুদ্ধ।
শেষে বুদ্ধ গাথায় বলেন,
সেকারণে পণ্ডিত ব্যক্তি তাদেরকে
অন্ন, বস্ত্র, পানীয় ও শয্যা দিয়ে,
গা মালিশ করে দিয়ে, গোসল করিয়ে, পা ধুইয়ে দিয়ে
সম্মান করবেন, সেবাপূজা করবেন।
মাতাপিতাকে সেবাপূজার কারণে পণ্ডিত ব্যক্তিগণ
ইহজীবনে তার প্রশংসা করে থাকেন।
অন্যদিকে, মরণের পরেও সে স্বর্গে সুখ ভোগ করে থাকে।
কাজেই আমাদের সবারই সাধ্যমত মা-বাবাকে সেবাযত্ন করা উচিত, সম্মান করা উচিত। এব্যাপারে আমার শুভাকাঙ্খী পুলকমিত্র চাকমার কথা মনে পড়ছে। সে যেভাবে তার মা-বাবাকে সেবাযত্ন করে চলেছে, তার জন্য সে বহু পণ্ডিত ব্যক্তির প্রশংসার দাবিদার। আর আমি বুদ্ধবাণীর উপর আস্থা রেখে নিশ্চিত বলতে পারি, স্বর্গেও তার জন্য নিশ্চয়ই আগাম একটা ফ্ল্যাট বুকিং দিয়ে রাখা আছে। বুদ্ধবাণী তো আর মিথ্যা হবার নয়!