বার্মাকে মূলত থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের দেশ বলে মনে করা হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে বিখ্যাত জাদী ও বিহারগুলোতে দেখা যায় লোকনাথ বা অবলোকিতেশ্বর, উপগুপ্ত ইত্যাদির বড় বড় মূর্তি। বোবো অং, বোমিন গাঁও ইত্যাদি বিদ্যাধরদের জন্য পূজার বেদী। হাতে বীণা নিয়ে সরস্বতীর মূর্তিকে দেখা যায় । লোকজনের বাড়িতে দেখা যায় বিভিন্ন স্থানীয় দেবদেবীর মূর্তি ও তাদের জন্য সাজিয়ে রাখা পূজার উপকরণ। এভাবে থেরবাদের পাশাপাশি তান্ত্রিক, মহাযানী ব্যক্তিত্ব এবং স্থানীয় দেবদেবীর পূজা হয় এখানে সাড়ম্বরে।

সোজা কথায়, বার্মার বৌদ্ধধর্ম হচ্ছে থেরবাদ, বজ্রযান, তন্ত্রমন্ত্র, হিন্দুধর্ম ও স্থানীয় দেবদেবী পূজার মিশেল। কিন্তু এতসব আসলো কোত্থেকে? তার জন্য আমাদের বার্মার অতীত ইতিহাসকে কিছুটা জানা দরকার।
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে পিউ লোকজন এসে বসতি স্থাপন করে বার্মার উত্তরাঞ্চলে। ভারতের সাথে বাণিজ্যের সুত্রে তাদের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করে। প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজ এবং চাইনিজ ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, পিউদের মূল ধর্ম ছিল থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদের মাঝে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, মহাযানী বৌদ্ধধর্ম এবং হিন্দুধর্মের চর্চা ছিল ব্যাপক। অবলোকিতেশ্বর (বার্মায় လောကနတ် লোকনাথ নামে পরিচিত), তারাদেবী, মানুষী বুদ্ধ ও অন্যান্য অনেক মহাযানী ব্যক্তিত্ব পিউদের ধর্মীয় সংস্কৃতির একটা অংশ ছিল। হিন্দুদের ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব, গরুড়, লক্ষ্মী ইত্যাদি দেবদেবীর মূর্তি দেখা যায়, বিশেষ করে বার্মার নিম্নাঞ্চলে। তারা টিকেছিল নবম শতক পর্যন্ত।
নবম শতাব্দীতে বার্মিজরা বাগান (ပုဂံ) শহরে বসতি গড়ে তোলে। তাদের ছোট্ট বসতি বাড়তে বাড়তে ক্রমান্বয়ে পরবর্তী দুইশ বছরের মধ্যে তা বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। পিউ লোকজন ক্রমান্বয়ে বার্মিজদের সাথে মিশে যায়। বার্মিজরা পিউদের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে।
বার্মার রাজা অনরথ (အနော်ရထာ Anawrahta) বাগানের সিংহাসনে আরোহণ করেন ১০৪৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনিই সর্বপ্রথম উত্তর বার্মার ছোট্ট একটা শহরকে বিস্তৃত করে বার্মিজ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। তাই তাকে বার্মিজ জাতির জনক বলা হয়ে থাকে।1 সিংহাসনে iআরোহণের পর ১০৬৬ সালে তিনি থেরবাদী বৌদ্ধধর্মকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। এর আগে সেখানে শক্তিশালী অবস্থানে ছিল আরি বৌদ্ধধর্ম (အရည်းဂိုဏ်း Ayi Gain)। আরি ভিক্ষুরা মূলত ছিল মহাযানী তন্ত্রযানী ভিক্ষু। তারা বনে জঙ্গলে অবস্থান করত। তারা বিকালে খেত, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে মদ পান করত, গবাদিপশুকে বলি দিত। তাদের বৌদ্ধধর্মের সাথে মিশে ছিল দেবতাদের পূজা–অর্চনা, স্থানীয় নাগদেরকে পূজা এবং হিন্দু ধর্মীয় কিছু রীতিনীতি।2 তাদের তান্ত্রিকতার জয়জয়কার ছিল প্রায় পাঁচ–ছয়শ বছর ধরে। পরবর্তীতে এগারশ শতকে রাজা অনরথ থেরবাদী বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে ধর্মীয় বিশুদ্ধি অভিযান শুরু করেন। যার ফলে আরি ভিক্ষুদেরকে বাধ্য হয়ে থেরবাদে মিশে যেতে হয়। কিন্তু সেখানেও তারা তাদের তান্ত্রিকতাকে বিদ্যার পথ (ဝိဇ္ဇာလမ်း Weizza Lan) নাম দিয়ে চালিয়ে যেতে থাকে, যদিও তার চর্চা চলতে থাকে সীমিত আকারে।
1 https://en.wikipedia.org/wiki/Anawrahta
2 https://en.wikipedia.org/wiki/Ari_Buddhism
i https://en.wikipedia.org/wiki/Pyu_city-states#Religion