অর্হৎকে চেনা কঠিন। যেমন মধ্যম নিকায়ের মহাসচ্চক সুত্রে বুদ্ধ বলেছেন, যখন তিনি বুদ্ধ হওয়ার জন্য কঠোর সাধনা করছিলেন তখন এক পর্যায়ে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ থাকা অবস্থায় দেহের প্রচণ্ড জ্বালাযন্ত্রণায় তিনি বসা অবস্থাতেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। তা দেখে কোনো কোনো দেবতা মনে করেছিল সিদ্ধার্থ মারা গেছেন। আবার কিছু কিছু দেবতা বলাবলি করছিল, সিদ্ধার্থ অর্হৎ হয়ে গেছেন। কারণ তারা মনে করত অর্হতেরা এভাবেই মরার মতো পড়ে থাকেন। এভাবে দেবতারা তখনো সিদ্ধার্থকে অর্হৎ হয়েছে বলে মনে করেছিল। (ম.নি.১.৩৭৮)
আবার বিনয় পিটকের মহাবর্গ অর্থকথায় বলা হয়েছে, বুদ্ধ যখন বুদ্ধত্ব লাভ করে এক সপ্তাহ পর্যন্ত বোধিবৃক্ষের গোড়ায় বসে ছিলেন, তখন কিছু কিছু দেবতা ভাবছিল তিনি এখনো আসন থেকে উঠছেন না কেন। তাহলে কি বুদ্ধত্ব লাভের জন্য আরো কাজ বাকি আছে তার? তখন অষ্টম দিনে তিনি সেই দেবতাদের সন্দেহ দূর করার জন্য আকাশে উঠে যুগ্ম অলৌকিক ঘটনা প্রদর্শন করেছিলেন। সেখানেও কিন্তু দেবতারা ভুল ধারণা পোষণ করেছে। (মহা.অ.৪)
শুধু বুদ্ধের ক্ষেত্রেই নয়, আরো কয়েকটা ঘটনা আছে যেখানে দেবতারা অর্হৎকে চিনতে পারে নি। যেমন এক ভিক্ষু পিণ্ডচারণে গিয়ে কেবল একটা ঘরে গিয়ে বসে থাকত। এক দেবতা ভেবেছিল ভিক্ষুটি যেভাবে কেবল একটা ঘরে গিয়ে বসে থাকে, তাতে বাড়ির লোকজনের সাথে বেশি ঘনিষ্ঠতাবশত যেকোনো সময় অঘটন ঘটাতে পারে। তাই সে তাকে সাবধান করে দিয়েছিল। অথচ ভিক্ষুটি ছিল অর্হৎ। (স.নি.১.২২৮)
আরেক ভিক্ষু প্রথমে খুব বুদ্ধবাণী শিক্ষা করত, আবৃত্তি করত। কিন্তু অর্হৎ হওয়ার পরে সে আর বুদ্ধবাণী সেরকম আবৃত্তি করত না। তাতেও এক দেবতা এসে তাকে প্রশ্ন করেছিল সে আবৃত্তি করে না কেন। এক্ষেত্রেও দেবতাটি জানত না যে ভিক্ষুটি অর্হৎ হয়ে গেছে। (স.নি.১.২৩০)
এভাবে আরো অনেক কাহিনী আছে যেখানে দেবতারা অর্হৎকে চিনতে পারে নি। আবার আরো অনেক কাহিনী আছে যেখানে দেবতারা জানত কে অর্হৎ আর কে অর্হৎ নয়।
যেমন ধর্মপদের সহস্রবর্গের বাহিয় দারুচীরিয়ের কাহিনী ধরা যাক। তাকে কাপড়চোপড় ছাড়া ঘুরতে দেখে লোকজন মনে করেছিল সে একজন অর্হৎ। কিন্তু এক ব্রহ্মা এসে তাকে বলেছিল, ওহে বাহিয়, তুমি অর্হৎও নও। অর্হত্বের পথেও তুমি চলছ না। এভাবে লোকজন বাহিয়কে অর্হৎ মনে করলেও সেই ব্রহ্মা কিন্তু ঠিকই তাকে চিনেছিল।
আবার ধর্মপদের যমকবর্গের নন্দ থেরোর কাহিনী ধরা যাক। সে যখন অর্হৎ হয়েছিল, তখন এক দেবতা এসে বুদ্ধকে জানিয়েছিল, নন্দ সকল কলুষতা বিদূরীত করে অর্হৎ হয়েছে। সেই দেবতাও কিন্তু ঠিকই নন্দের অর্হত্ব প্রাপ্তিকে চিনতে পেরেছিল।
তাহলে এখানে রহস্যটা কোথায়? কেন কোনো কোনো দেবতা অর্হৎকে চিনতে পারে? কোনো কোনো দেবতা পারে না?
এর উত্তর হচ্ছে, যেসব দেবতা অর্হৎ, কেবল তারাই অর্হৎদেরকে চিনতে পারে। যেমন উদান অর্থকথায় বলা হয়েছে, নন্দের অর্হৎ হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছিল যে দেবতা, সে ছিল একজন ব্রহ্মলোকের দেবতা। সেই ব্রহ্মা নিজে অর্হৎ হওয়ায় অন্যের অর্হত্বকে জানতে পেরেছিল।[১]
তারপরও একটা প্রশ্ন রয়ে যায়। দীর্ঘনিকায়ের শ্রামণ্যফল সুত্রে বলা হয়েছে, চতুর্থধ্যানের মাধ্যমে চিত্ত বিচরণ জ্ঞান দিয়ে জানা যায় এটি লোভযুক্ত চিত্ত, লোভহীন চিত্ত, বিদ্বেষযুক্ত চিত্ত, বিদ্বেষহীন চিত্ত, মোহযুক্ত চিত্ত, মোহহীন চিত্ত, সংক্ষিপ্ত চিত্ত, বিক্ষিপ্ত চিত্ত, মহান চিত্ত, অমহান চিত্ত, অশ্রেষ্ঠ চিত্ত, শ্রেষ্ঠ চিত্ত, সমাহিত চিত্ত, অসমাহিত চিত্ত, বিমুক্ত চিত্ত, অবিমুক্ত চিত্ত। (দী.নি.২৪২)। তাহলে সেখানে অর্হৎ হওয়ার প্রয়োজন হবে কেন?
সেটার উত্তর অবশ্য মহাসতিপট্ঠান সুত্রের অর্থকথায় আছে। সেখানে বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে যে লোভযুক্ত, লোভহীন ইত্যাদি চিত্তের কথা বলা হয়েছে সেগুলোর একটাতেও লোকোত্তর চিত্তকে উদ্দেশ্য করে বলা হয় নি।
যেমন সেখানে লোভযুক্ত মানে হচ্ছে আট প্রকার লোভসহগত চিত্ত। লোভহীন চিত্ত হচ্ছে লৌকিক কুশল চিত্তগুলো এবং অব্যক্ত বা অনির্দিষ্ট চিত্তগুলো। বিদ্বেষযুক্ত চিত্ত হচ্ছে দুই প্রকার দৌর্মনস্য সহগত চিত্ত। বিদ্বেষহীন চিত্ত হচ্ছে লৌকিক কুশল ও অনির্দিষ্ট চিত্ত। মোহযুক্ত চিত্ত হচ্ছে দুই প্রকার মোহযুক্ত চিত্ত। মোহহীন চিত্ত হচ্ছে লৌকিক কুশল ও অনির্দিষ্ট চিত্ত। সংক্ষিপ্ত চিত্ত হচ্ছে তন্দ্রা-আলস্যে পতিত চিত্ত। বিক্ষিপ্ত চিত্ত হচ্ছে ঔদ্ধত্য বা চঞ্চলতা সহগত চিত্ত। মহান চিত্ত হচ্ছে রূপাবচর ও অরূপাবচর চিত্ত। অমহান চিত্ত হচ্ছে কামাবচর চিত্ত। অশ্রেষ্ঠ চিত্ত হচ্ছে কামাবচর। শ্রেষ্ঠ চিত্ত হচ্ছে রূপাবচর ও অরূপাবচর চিত্ত। সমাহিত চিত্ত হচ্ছে অর্পণা বা উপচার ধ্যানলাভীর চিত্ত। অসমাহিত মানে হচ্ছে ধ্যানহীনের চিত্ত। বিমুক্ত মানে হচ্ছে শীল ও ধ্যানের মাধ্যমে কলুষতাগুলো থেকে বিমুক্ত। অবিমুক্ত মানে হচ্ছে সেরকম কলুষতামুক্ত নয়। লোকোত্তর বিমুক্তি এখানে অন্তর্ভুক্ত হয় নি।
কিন্তু অনেকেই বলতে পারেন- সেটা তো মহাসতিপট্ঠান সুত্রের কথা। সেখানে তো অভিজ্ঞার কথা বলা হয় নি। তাই মহাসতিপট্ঠান সুত্রের অর্থকথার ব্যাখ্যা এই চিত্তবিচরণ জ্ঞানের ব্যাখ্যায় প্রযোজ্য হবে কেন? তার জন্য চাই চিত্তবিচরণ জ্ঞানের আলোচনার রেফারেন্স। সেরকম রেফারেন্স কিছু কোথাও দেখানো যাবে কি?
সৌভাগ্যবশত সেরকম আলোচনা আমরা দেখতে পাই বিশুদ্ধিমার্গের মহাটীকার অভিজ্ঞানির্দেশ বর্ণনায়। সেখানে বলা হয়েছে, এই অভিজ্ঞাকথা হচ্ছে সাধারণ জনের ভিত্তিতে। লোকোত্তর চিত্তকে এখানে টেনে আনা হয় নি। তবে লোকোত্তরের ক্ষেত্রেও উচ্চতর বা সমান মার্গফললাভী ব্যক্তিরা নিম্নতর বা সমান মার্গফললাভীদের চিত্তকে জেনে থাকে। [২]
আর এর সপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে বিশুদ্ধিমার্গের অভিজ্ঞা নির্দেশ অধ্যায়ে। সেখানে বলা হয়েছে, সাধারণ ব্যক্তি স্রোতাপন্নের চিত্তকে জানে না। স্রোতাপন্ন ব্যক্তি সকৃদাগামীর চিত্তকে জানে না। অর্হৎ কিন্তু সব ধরনের লোকোত্তর চিত্তকে জানে। [৩]
এভাবে আমরা দেখলাম কেবল চিত্তবিচরণ জ্ঞান দিয়ে অর্হতের চিত্তকে জানা যায় না। তাই সাধারণ দেবতারা অর্হৎদেরকে চিনতে পারবে এমন ধারণা অমূলক। একমাত্র অর্হৎ দেবতারাই অর্হৎদেরকে চিনতে পারে। অর্হৎ দেবতা বলতে এখানে কেবল ভূমিবাসী দেবতা ও ব্রহ্মাদেরকে বুঝানো হয়েছে। অন্যান্য স্বর্গের দেবতারা অর্হৎ হলে সাথে সাথে পরিনির্বাপিত হতে হয়।
রেফারেন্স:
[১] অঞ্ঞতরা দেৰতাতি অধিগতমগ্গা একা ব্রহ্মদেৰতা। সা হি সযং অসেক্খত্তা অসেক্খৰিসযং অব্ভঞ্ঞাসি। সেক্খা হি তং তং সেক্খৰিসযং, পুথুজ্জনা চ অত্তনো পুথুজ্জনৰিসযমেৰ জানন্তি। – উদান-অট্ঠকথা => ৩. নন্দৰগ্গো => ২. নন্দসুত্তৰণ্ণনা
[২] পুথুজ্জনৰসেনাযং অভিঞ্ঞাকথাতি লোকুত্তরং চিত্তং ইধ অনুদ্ধটং। তম্পি হি উপরিমো, সদিসো ৰা অরিযো হেট্ঠিমস্স, সদিসস্স চ চিত্তম্পি পজানাতি এৰ। – ৰিসুদ্ধিমগ্গ-মহাটীকা-২ => ১৩. অভিঞ্ঞানিদ্দেসৰণ্ণনা => চেতোপরিযঞাণকথাৰণ্ণনা
[৩] এত্থ চ পুথুজ্জনো সোতাপন্নস্স চিত্তং ন জানাতি। সোতাপন্নো ৰা সকদাগামিস্সাতি এৰং যাৰ অরহতো নেতব্বং। অরহা পন সব্বেসং চিত্তং জানাতি। অঞ্ঞোপি চ উপরিমো হেট্ঠিমস্সাতি অযং ৰিসেসো ৰেদিতব্বো। – ৰিসুদ্ধিমগ্গ-২ => ১৩. অভিঞ্ঞানিদ্দেসো => পকিণ্ণককথা
বন্দনা ভান্তে। আজকের এই অষ্টশীলের দিনে আপনার এই লেখাটা পড়ে ভালো লাগল। আবার একটা প্রশ্নেরও উদয় হলো আর তা হলোঃ
আমরা জানব যে অরহৎ মার্গ লাভী ভান্তে কিংবা গৃহী আর পূণর্জন্ম গ্রহণ করে না। তাহলে দেবতা বা ব্রম্মা হয় কেন? তাহলে অতীত কিংবা বর্তমান বুদ্ধ অথবা নির্বাণ এবং অরহৎ লাভীরা তবে কোথায় অবস্থান করছেন?
অর্হৎ হলে মৃত্যুর পরে সে আর জন্মগ্রহণ করে না। সে মানুষ, দেবতা, ব্রহ্মা যাই হোক না কেন। তার আয়ু শেষে সে নির্বাণে প্রবেশ করে থাকে। সেই নির্বাণটা লৌকিক নয়, এই একত্রিশ লোকভূমির কোথাও সেই নির্বাণকে দেখিয়ে দেয়া যায় না। সোজা কথায় সেটা স্থান-কালের অতীত। Nibbana is beyond space and time.