আমার হোয়াটসএ্যাপে হঠাৎ একটা মেসেজ পেলাম, গুরুদেব উচহ্লা ভান্তে নাকি মারা গেছেন। সাথে প্রমাণ হিসেবে একটা শেষ মুহুর্তের ছবি। আমি চমকে গেলাম। সেটা আবার কী কথা? এই তো কিছুদিন আগেও তিনি সিংহগর্জনে চাকমাদের ইতিহাস নিয়ে খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। জাতির এমন আলোর দিশারী তেজোদীপ্ত একজন ভান্তে এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবেন তা তো হতে পারে না।
তাই উচহ্লা ভান্তের নামে একটু ফেসবুকে সার্চ দিলাম। দেখলাম খবরটা সত্যি। অনেকেই পোস্ট দিয়েছে ফেসবুকে। কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করলাম, তার মারা যাওয়ার খবরে লোকজন কমেন্ট করছে সাধু সাধু বলে। আমার মনে একটু খটকা লাগল। তার মৃত্যুর খবরে লোকজন সাধুবাদ দিচ্ছে কেন? কারো মরণ কি সাধুবাদের বিষয়? কারো ভালো কোনো খবরে আমরা সাধুবাদ দিয়ে থাকি। তাতে তারও পুণ্য হয়, আমাদেরও পুণ্য হয়। কিন্তু মরণকে সাধুবাদ দিতে শিখল কোত্থেকে লোকজন?
সারিপুত্র ভান্তে যখন শেষ বিদায় নিতে এসেছিলেন বুদ্ধের কাছে, বুদ্ধ তখন তাকে বেঁচে থাকতেও বলেন নি, আবার মরতে যাচ্ছে বলে হাহুতাশও করেন নি। বুদ্ধগণ এক সেকেণ্ডের জীবনও প্রশংসা করেন না। কিন্তু তাই বলে আমার মরণকেও প্রশংসা করেন না। জীবন, মৃত্যু ঊভয়ক্ষেত্রেই তারা থাকেন নির্লিপ্ত। কিন্তু কোনো ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে শুনলে লোকজন তো নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। তাদের সৌজন্যতামূলক কিছু একটা বলতে হয়। কী বলা যায় তখন?
আমরা সেটা মহাকাশ্যপ ভান্তের সহচর ভিক্ষুদের কাছ থেকে শিখে নিতে পারি, যেটা আছে দীর্ঘনিকায়ের মহাপরিনির্বাণ সুত্রে। বুদ্ধের পরিনির্বাণের সময়ে মহাকশ্যপ ভান্তে কুশিনগর অভিমুখে রওনা দিয়েছিলেন তার সহচর ভিক্ষুদের নিয়ে। প্রচণ্ড রোদে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন ভিক্ষুরা। তাই কোনো এক গাছতলায় দোয়াজিক বিছিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলেন তারা। এসময় এক সন্ন্যাসী বড়সড় ফুলদানির মতো মান্দারফুলকে লাঠিতে বেঁধে নিয়ে ছাতার মতো করে ধরে সেই পথ ধরে আসছিল। দেখে মহাকাশ্যপ ভান্তে ভাবলেন, এই স্বর্গীয় মান্দার ফুল মনুষ্যলোকের পথেঘাটে দেখা যায় না। ভগবান নিশ্চয়ই পরিনির্বাপিত হয়েছেন। তবুও তিনি সেই সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞেস করলেন, “বন্ধু, আমাদের শাস্তার খবর জানেন?”
“হ্যাঁ। জানি তো। শ্রমণ গৌতম পরিনির্বাপিত হয়েছেন সপ্তাহখানেক হলো। সেখান থেকেই এই মান্দারফুল এনেছি।”

তা শুনে যেসব ভিক্ষুরা লোভদ্বেষ তখনো ক্ষয় করতে পারে নি তাদের কেউ কেউ হাহাকার করে কেঁদে উঠল, কেউ কেউ মাটিতে পড়ে গেল, কেউ কেউ শোকে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগল, ছটফট করতে লাগল এই বলে, “ভগবান এত তাড়াতাড়ি পরিনির্বাপিত হলেন। এত তাড়াতাড়ি সুগত পরিনির্বাপিত হলেন। এত তাড়াতাড়ি জগতের আলো হারিয়ে গেল।”
কিন্তু যারা লোভদ্বেষমোহ ক্ষয় করেছিল তারা জেনে বুঝে নিরবে তা সহ্য করল, “সৃষ্টিগুলো অনিত্য। এর অন্যথা কোথা থেকে হবে?”
এই ছিল বুদ্ধের পরিনির্বাণের খবরে তখনকার ভিক্ষুদের প্রতিক্রিয়া। এখন দেখুন, যারা বাস্তবতাকে বুঝতে শেখে নি তারা তাদের প্রিয়জনের মৃত্যুর খবরে কাঁদবে, মাটিতে গড়াগড়ি খাবে, হাহুতাশ করবে, বিলাপ করবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু যারা বাস্তবতাকে বুঝেছে, যারা বৌদ্ধধর্মে শিক্ষিত, তারা বলবে, “সৃষ্টি মাত্রেই অনিত্য। এর অন্যথা কোথায় হবে?”
কিন্তু যারা বৌদ্ধধর্মে অশিক্ষিত বৌদ্ধ, তারা শুনে কাঁদবেও না, হয়তো একটু হাহুতাশ করবে, তারপর তার মৃত্যুকে সাধুবাদ দিয়ে বলবে, সাধু সাধু সাধু!
আমি আশা করব, বৌদ্ধধর্মে শিক্ষিত যারা আছেন তারা কারো মৃত্যুতে সাধুবাদ দেবেন না। আবার তার আত্মার মাগফেরাতও কামনা করবেন না। অথবা বলবেন না, “উপরওয়ালা তার বিদেহী আত্মার উপর শান্তি বর্ষণ করুক!” বরং বলবেন, “সৃষ্টি মাত্রেই অনিত্য।” অথবা “অনিত্য সংসার।” অথবা পালি ভাষায়, “অনিচ্চা ৰত সঙ্খারা।” এটাই একজন বৌদ্ধধর্মে শিক্ষিত বৌদ্ধ বলে থাকে। এই শিক্ষা হচ্ছে অনিত্যের শিক্ষা, যা নির্বাণের দিকে ধাবিত করে।
বন্দনা ভান্তে, হিলের বৌদ্ধরা আসলে জন্মগত বৌদ্ধ, সেজন্য কোথায় সাধুবাদ দিতে হবে! কোথায় আম্ ভান্তে বলতে হবে তা জানে না।সেজন্য উছালা ভান্তের মৃত্যুতে কিভাবে বার্তা দিতে হবে তাও জানে না।
বন্দনা ভান্তে। তবে কি মৃত ব্যক্তির “ভবিষতে নির্বাণ সুখ কামনার জন্য আমি আমার সঞ্চিত পূণ্য রাশি দান করছি” এভাবে বলা বা লিখা যাবে?
লিখলে তো সমস্যা নেই। তবে সত্যিই পুণ্য পেল কিনা সেটাই ভাববার বিষয়। বলা আর লেখা অনেক ক্ষেত্রে এক নয়।
বন্দনা ভান্তে। একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে জানার জন্য উসখুস করছে। জানতে পারলে স্বস্তি পেতাম। প্রশ্নটা হলো বুদ্ধ ভান্তে, শ্রমণদের মাথা মুন্ডন করে থাকা নির্দেশ দিয়েছিলেন কারণ সৌন্দর্যের প্রতি তৃষ্ণা না থাকার জন্য তবে বুদ্ধ নিজে কেন মাথা মুন্ডন করেন নি। উনার তৃষ্ণা তো বুদ্ধত্ব লাভের সাথে সাথেই ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র জানার জন্যে প্রশ্নটি করা।
আমি যদ্দূর জানি, বুদ্ধ মাথা ন্যাড়া করেছিলেন সেই একবার, অনোমা নদীর তীরে। তখন থেকে তার চুলগুলো আর বড় হয় নি। সেই দুই আঙুল লম্বা রয়ে গিয়েছিল। আর বুদ্ধের চুলগুলো হচ্ছে অন্যরকম। তার চুলগুলো কোঁকড়ানো, ডানপাক খেয়ে কুঁকড়ে থাকত, চুলের ডগা থাকত উর্ধ্বমুখী। সেটা ৩২ মহাপুরুষ লক্ষণের একটা। একারণেই আপনি দেখবেন বুদ্ধমূর্তিগুলোর চুলগুলো সেরকম।
তবে অনেকেই সেগুলোকে শামুক বলে মনে করে থাকে। লোকজন গল্প বানিয়েছে যে, বুদ্ধের মাথার উপরের উঁচু চুলগুলো নাকি শামুক। বুদ্ধ যখন নৈরঞ্জনার নদীতীরে কঠোর সাধনা করছিলেন, তখন নাকি তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তখন নদী থেকে উঠে এল সারি সারি শামুক। তারা বুদ্ধের মাথার উপর বসে শীতল করে দিল বুদ্ধের মাথা। মাথা ঠাণ্ডা করে ধ্যানে মন দিলেন তিনি। লাভ করলেন বুদ্ধত্ব!