অক্রিয়াবাদী
আমাদের মধ্যে অনেকেই মনে করে পাপ পুণ্য বলতে কিছু নেই। প্রাণিহত্যা করলে পাপ হয় না। দান করলে পুণ্য হয় না। এভাবে এরা কর্মে বিশ্বাস করে না। বৌদ্ধধর্মে এদেরকে বলা হয় অক্রিয়াবাদী। আমি এদেরকে বলি অকর্মবাদী।
অহেতুকবাদী
আবার অনেকেই মনে করে, ধনী, গরীব ইত্যাদির কোনো হেতু নেই, কারণ নেই। সবকিছুই হচ্ছে নিয়তির লিখন। নিয়তির বিধানে প্রাণিরা এই জগতে জন্ম থেকে জন্মান্তরে ঘুরে ঘুরে অবশেষে একসময় দুঃখ থেকে মুক্ত হয়। তখন এমনিতেই তো তারা নির্বাণ পায়। তাহলে আর প্রচেষ্টা চালিয়ে কী লাভ? এভাবে তারা কর্ম ও ফল উভয়কেই অস্বীকার করে এবং নিয়তির হাতে সবকিছু ছেড়ে দেয়। বৌদ্ধধর্মে এদেরকে বলা হয় অহেতুকবাদী। আমি বলি নিয়তিবাদী।
নাস্তিক্যবাদী
আবার অনেকেই মনে করে, দানের ফল নেই, পিতামাতাকে ভরণপোষণের ফল নেই, স্বর্গনরক নেই, দেবতা নেই। ফলে তারা নিজেরাও দান দেয় না, অন্যদেরকেও দান করতে বারণ করে। এভাবে তারা ফলকে অস্বীকার করে এবং চরম বস্তুবাদী হয়ে ওঠে। বৌদ্ধধর্মে এদেরকে বলা হয় নাস্তিক্যবাদী বা নাস্তিক। আমি বলি বস্তুবাদী।
ইদানিং আবার কেউ কেউ আছে যারা বৌদ্ধধর্মের মধ্যে কোনো কোনো বিষয়কে পছন্দ করে, আবার কোনো কোনো বিষয়কে পছন্দ করে না। উদাহরণস্বরূপ তারা দান করে ঠিকই, কিন্তু স্বর্গনরকে বিশ্বাস করে না। দেবতা, যক্ষ আছে বলে বিশ্বাস করে না। কারণ কী? কারণ দেবতা বা যক্ষের ধারণা নাকি বিজ্ঞানসম্মত নয়। এভাবে তারা বুদ্ধের অর্ধেক কথাকে বিশ্বাস করে, অর্ধেক কথাকে বিশ্বাস করে না। এদেরকে আংশিক বস্তুবাদী বলা যায়।
এই তিন ধরনের ধারণাকে বৌদ্ধধর্মে বলা হয় মিথ্যাদৃষ্টি। যারা এই ধারণাগুলোকে একটু আধটু গ্রহণ করে, তাদেরকে বলা হয় অনিয়ত মিথ্যাদৃষ্টিক। তাদেরকে ভালো করে বুঝালে হয়তো শোধরানো যায়। কিন্তু যারা দৃঢ়ভাবে সেধরনের মতবাদ গ্রহণ করেছে তারা হয়ে যায় নিয়ত মিথ্যাদৃষ্টিক। তাদেরকে আর শোধরানো যায় না। কোনোমতেই আর বুঝানো যায় না।
এমনিতে যেকোনো ধারণা হচ্ছে কেবল ধারণা মাত্র। সেগুলো ভালোও নয়, খারাপও নয়। কিন্তু কেউ যদি এমন ধারণা গ্রহণ করে রাতদিন বসে বসে সেগুলো আওড়ায় এবং সেই ধারণার ভিত্তিতে সবকিছুকে বিচার বিশ্লেষণ করতে থাকে, তখন সেরকম চিন্তাতেই তার মন নিবিষ্ট হয়ে পড়ে। সেরকম চিন্তায় মনোনিবেশ করলে সেটা তখন কর্মে পরিণত হয়। সেই মন নিয়ে কথা বললে তখন সেটা হয় বাচনিক কর্ম। সেই মন নিয়ে কাজ করলে সেটা হয় কায়িক কর্ম। এভাবেই একটা ভুলধারণাকে ভিত্তি করে তিন প্রকারে পাপকাজ হতে থাকে অবিরত।
বুদ্ধের আমলের অরিট্ঠ ভিক্ষু, কণ্টক শ্রমণ ইত্যাদির মতো তারা আর সেই ভুলধারণা থেকে বের হতে পারে না, ভুলপথ থেকে ফিরতে পারে না। যার ফলে এই জন্মে মরণের পরে তার স্বর্গে উৎপত্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে, মার্গফল তো দূরের কথা। নরক অথবা ইতর প্রাণিকুলই হয় তার পরজন্মের গন্তব্য। (অঙ্গু.০৪.৩০)
তাই আমাদের এসব ভ্রান্তবাদীদের থেকে দূরে থাকা উচিত। আমাদের বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাকে আরো গভীর করা উচিত। আমাদের হওয়া উচিত ধর্মবাদী। দান ও সেবার ফল আছে বলে আমাদের বিশ্বাস করা উচিত। স্বর্গনরক আছে বলে বিশ্বাস করা উচিত। নির্বাণ আছে বলে বিশ্বাস করা উচিত। সেই বিশ্বাস নিয়ে দান করা উচিত, শীল পালন করা উচিত, ভাবনায় মনোযোগ দেয়া উচিত। তবেই আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ ও সুখের হতে পারে। তার আগে নয়।