আগের পোস্টে আমি এক ইন্দোনেশিয়ান ভিক্ষু ও তার বাবা-মায়ের ব্যাপারে লিখেছিলাম। এই ভিক্ষুটি আমাকে নিয়ে গিয়েছিল পাঅক পরিয়ত্তি শিক্ষাকেন্দ্রে। গিয়ে দেখলাম সেখানে বিদেশি ভিক্ষু আছে কয়েকজন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুয়েকজন বাদে তাদের সবাই আমার পরিচিত। পাঅক ভাবনাকেন্দ্রে থাকার সময়ে এদের কয়েকজনের সাথে আমার বেশ চেনাজানা হয়ে উঠেছিল। তাই অনেকদিন পরে তাদের দেখা পেয়ে মনটা খুশিতে ভরে উঠল। আমি তাদের কাছে পাঅকের খবর নিলাম।
একজন আমাকে অনেকগুলো ছবি দেখাল। পাঅকের ভিয়েতনামিজ ভিক্ষুদের গ্রুপ ছবি। সে তাদের মধ্যে একজনের ছবি দেখিয়ে বলল, ভান্তে, একে চেনেন? আমি চিনতে পারলাম। নাম মনে নেই, কিন্তু তাকে আমার বেশ মনে আছে। পাঅক ভাবনাকেন্দ্রে আমরা দিনে পাঁচবার সমবেত ধ্যান করতাম। প্রতিবারে দেড় ঘন্টা বসে থাকতে হতো ধ্যানে। এই ভিক্ষুটি বসত আমার সামনে। কাজেই কথাবার্তা না হলেও কমপক্ষে দিনে পাঁচবার তার সাথে দেখা হতো। তাহলে মনে থাকবে না কেন?
আমি বললাম, একে আমি চিনি তো। খুব শান্তশিষ্ট ও চুপচাপ ধরনের ছিল। কারো সাথে খুব একটা কথাবার্তা বলতে দেখি নি। কেন? কী হয়েছে? তখন সে বলল, গত বর্ষাবাসের মধ্যে এই ভিক্ষুটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। সে রাতদুপুরে পিণ্ডচারণ করতে বের হয়েছিল। আমি অবাক হয়ে গেলাম। বলো কী? কী হয়েছে খুলে বলো তো শুনি। সে জানাল, এই ভিক্ষুটি মাঝরাতে উঠে পিণ্ডচারণে গিয়েছিল ডাইনিং রুমে। কিন্তু ডাইনিং রুম তো বন্ধ। তাই সে হেঁটে হেঁটে গিয়েছিল বিহারের বাইরে পাঅক গ্রামে পিণ্ডচারণ করতে। শুনে ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। কী দুঃসাহসিক কাজ করেছে এই ভিক্ষুটি! পাঅক থেকে বিহারের গেট হচ্ছে অনেক দূরে। প্রায় দুই কিলোমিটারের মতো হাঁটতে হয়। মাঝখানে আছে আকাশছোঁয়া রবার গাছের বন। সেই বন পেরোলেই রাস্তার পাশে একটা বেশ বড়সড় কবরস্থান। দিনের বেলাতেই একাকী গেলে গা ছমছম করে ওঠে। তাহলে মাঝরাতে কী অবস্থা হবে?
পাঅকের প্রবেশদ্বারে ট্রাফিক লাইটের মতো অনেকগুলো সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো আছে। রাতের বেলা গাড়ি নিয়ে টহল দেয় লোকজন। তারা নাকি ভিক্ষুটাকে দেখে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ভান্তে আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সে বলেছিল, আমি জানি না। আমি শুধু জানি, পিণ্ডচারণ করতে হবে। তখন তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আবার বিহারে ফেরত আনা হয়। পরে মানসিক ভারসাম্য ফিরে না আসায় বর্ষাবাসের মধ্যেই তাকে ভিয়েতনামে ফেরত পাঠানো হয়।
আমি আনমনে মাথা নাড়লাম। এরকম হতে পারে তো। অস্বাভাবিক কিছু নয়। ভাবনা করা মানেই হচ্ছে মনকে ট্রেনিং দেয়া। শক্তসমর্থ না হলে এই ট্রেনিংয়ে উতরে যাওয়া কঠিন।
পাঅকে আরেকটা ভয়ংকর ঘটনার কথা জানাল তারা। গত বর্ষাবাসের মধ্যেই সেখানে আত্মহত্যা করেছে এক বার্মিজ ভিক্ষু। সে থাকত পাহাড়ের উপরে, জঙ্গলের মধ্যে একটা কুটিরে। কয়েকদিন পরে তার লাশ পাওয়া যায় গাছ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায়। আমি তার ছবিগুলো দেখলাম। গলা ফুলে আছে। হাত-পা টানটান হয়ে আছে। পা মাটির সাথে লেগে আছে। হাতে ও মাথায় ক্রিমি কিলবিল করছে। ছবিগুলো দেখে আমার বনবিহারে আত্মহত্যা করা কয়েকজন ভিক্ষুর কথা মনে পড়ে গেল।
রাজবন বিহারেও এরকম কয়েকজন আত্মহত্যা করেছে। কেউ ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। কেউ ফাঁসিতে ঝুলেছে। সেগুলো নিয়ে কত জল ঘোলা হলো। তাদের সাথে বনভান্তেকে জড়িয়ে এই ফেসবুকেই কত লেখা লিখল বিরুদ্ধবাদীরা। তাদেরকে নিয়ে আমি আর কথা বাড়াব না। তাদের নিন্দাজনিত কর্মের ফল তারাই ভোগ করবে। তবে আমি আগেই বলেছি, প্রাণিহত্যাজনিত কর্মফলের কারণেই আত্মহত্যা হয়ে থাকে। কেউ যদি তাকে হত্যা না করে, তাহলে সে নিজেই আত্মহত্যা করে থাকে। কর্মফল এমনই অমোঘ। তাই এমন মৃত্যুর সাথে কাউকে জড়ানো অমূলক। কারোর দুর্নাম রটিয়ে নিজের পাপের বোঝা ভারী করার কোনো কারণও আমি দেখি না।
বি:দ্র: আত্মহত্যার ব্যাপারে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম। সেটা পড়তে পারেন এখানে: আত্মহত্যা মহাপাপ নয়, পাপের ফলেই আত্মহত্যা হয়।