আগের লেখাতে আমি গুগলম্যাপে মাপজোখ করে দেখিয়েছিলাম যে, এক যোজন = ১২ কিলোমিটার। কিন্তু তাতে কী আসে যায়? আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলছি তাতে অনেক কিছু আসে যায়। মাপজোখ হচ্ছে বিজ্ঞানের অস্ত্র। তাই বিজ্ঞানের প্রথমেই আমাদেরকে মাপজোখ করতে শেখানো হয়, তাই না?
আচ্ছা, এবার তাহলে কয়েকটা জিনিসের মাপজোখ বের করা যাক। ত্রিপিটকের পারাজিকা অর্থকথার ৰেরঞ্জকণ্ডৰণ্ণনায় পৃথিবী, চাঁদ, সূর্য ইত্যাদি অনেকগুলোর মাপজোখ দেওয়া হয়েছে। আলোচনার সুবিধার্থে আমি এখানে কেবল পৃথিবীর ব্যাস এবং হিমালয়ের উচ্চতা নিয়ে আলোকপাত করব।
পৃথিবীর ব্যাস সম্পর্কে পারাজিকা অর্থকথার ৰেরঞ্জকাণ্ডে বলা হয়েছে, ‘একং চক্কৰাল়ং আযামতো চ ৰিত্থারতো চ যোজনানং দ্বাদস সতসহস্সানি তীণি সহস্সানি চত্তারি সতানি পঞ্ঞাসঞ্চ যোজনানি(পারা.অ.১)।’ অর্থাৎ পৃথিবীর ব্যাস হচ্ছে ১২,০৩,৪৫০ যোজন। বলে নেয়া ভালো, বৌদ্ধমতে পৃথিবী হচ্ছে চাকার মতো গোলাকার এবং সমতল। জানি, আপনারা বলবেন পৃথিবী তো সমতল নয়, বরং কমলালেবুর মতো গোল। আমি সেটা নিয়ে পরবর্তীতে লিখব, তাই এখানে আর কথা বাড়াবো না।
এখন আসল কথায় আসি। ১ যোজন = ১২ কিমি ধরে হিসাব করলে তাহলে অর্থকথার হিসেবে পৃথিবীর ব্যাস দাঁড়ায় ১৪ মিলিয়ন কিলোমিটারেরও বেশি। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে, পৃথিবীর ব্যাস সর্বসাকুল্যে ১৩ হাজার কিলোমিটারের কাছাকাছি। দেখুন তো, অর্থকথা বলছে কয়েক মিলিয়ন, অথচ বিজ্ঞান বলছে মাত্র কয়েক হাজার। কোথায় মিলিয়ন আর কোথায় হাজার। আকাশে পাতালে পার্থক্য। এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে প্রাচীন অর্থকথাগুলো নিশ্চয়ই ভুল বলছে!
আচ্ছা, এবারে হিমালয়ের উচ্চতা মিলিয়ে দেখা যাক। পারাজিকা অর্থকথা বলছে, ‘যোজনানং সতানুচ্চো, হিমৰা পঞ্চ পব্বতো (পারা.অ.১)।’ অর্থাৎ হিমালয় পর্বতের উচ্চতা হচ্ছে ৫০০ যোজন। ১ যোজন = ১২ কিমি হিসেবে তাহলে অর্থকথামতে হিমালয়ের উচ্চতা হয় ৬০০০ কিলোমিটার। অথচ আমরা জানি হিমালয়ের সর্বোচ্চ পর্বত এভারেস্টের উচ্চতাও মাত্র ৮.৮ কিলোমিটার। কীসের সাথে কীসের তুলনা! অর্থকথাগুলো নিশ্চয়ই গাঁজাখুরি গপ্পো ফেঁদে বসেছে, তাই না? এভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিরীহ লোকজনকে বোকা বানানো হচ্ছে। বৌদ্ধধর্ম নাকি বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম! অথচ হিসেবে বিজ্ঞানের ধারেকাছেও নেই। তাহলে এই ধর্ম নিয়ে পড়ে থেকে লাভ কী?
আচ্ছা, একটু দাঁড়ান। হুট করে ত্রিপিটক ও অর্থকথাকে উড়িয়ে না দিয়ে বরং ধরে নেয়া যাক অর্থকথা যা বলছে ঠিকই বলছে। ধরে নেয়া যাক পৃথিবীর ব্যাস ঠিকই ১৪ মিলিয়ন কিলোমিটার। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি মাত্র ১৩ হাজার কিলোমিটারের পৃথিবীটাকে। পার্সেন্টেজ হিসেব করলে সেটা হয় ০.০৯% মাত্র। অর্থাৎ কেবল ০.০৯% পৃথিবী আমাদের কাছে দৃশ্যমান। বাদবাকি ৯৯.৯১% পৃথিবী আমাদের চোখে অদৃশ্য। আজগুবি মনে হচ্ছে তো? দয়া করে পড়তে থাকুন।
হিমালয়ের উচ্চতাও ঠিকই ৬০০০ কিলোমিটার। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি কেবল ৮ কিলোমিটার। পার্সেন্টেজ হিসেবে সেটা হয় মাত্র ০.১৫% মাত্র। হিমালয়ের বাকি ৯৯.৮৫% আমাদের কাছে অদৃশ্য। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রেই ৯৯% জিনিস আমাদের কাছে অদৃশ্য। আমরা সেগুলো সাধারণ চোখে দেখতেই পাই না। এরকম কি হতে পারে না? বিলকুল হতে পারে।
তাহলে একটু দেখে নিই বিজ্ঞান কী বলছে। আমরা আমাদের চারপাশে কী দেখি? আমরা দেখি লোকজন, গাছপালা, পথঘাট, নদীনালা, সাগর, পর্বত, অণুপরমাণু, গ্রহনক্ষত্র, ছায়াপথ ইত্যাদি। এগুলোই আমাদের কাছে দৃশ্যমান। এগুলো নিয়েই আমাদের চেনাজানা পৃথিবী। আমরা মনে করি এটাই সবকিছু। কিন্তু উইকিপিডিয়া বলছে, আমাদের এই দৃশ্যমান পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, ছায়াপথ সবই হচ্ছে মহাবিশ্বের কেবল ৪.৯% মাত্র। বাকি ৯৫.১% হচ্ছে আমাদের কাছে অদৃশ্য। মহাবিশ্বের এই বিশাল অদৃশ্য অংশকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য পদার্থ এবং ডার্ক এনার্জি বা অদৃশ্য শক্তি। এই অদৃশ্য পদার্থকে তারা দেখেন না, ধরতে পারেন না, ছুঁতে পারেন না। অথচ তারা জানেন যে সেখানে একটা কিছু আছে। বেশ বড়সড় একটা কিছু আছে।
আপনারা এখানে পার্সেন্টেজের বিষয়টা একটু খেয়াল করে দেখুন। অর্থকথামতে, ৯৯% পৃথিবী আমাদের কাছে অদৃশ্য। আর বিজ্ঞান বলছে ৯৫% দুনিয়া আমাদের কাছে অদৃশ্য। অর্থাৎ অদৃশ্য জগত নিয়ে বিজ্ঞান ও বৌদ্ধধর্মের হিসাব প্রায় একই, তাই না? তবে আজ আপাতত এ পর্যন্তই। পরে এব্যাপারে আরো লিখব। সবার জন্য শুভকামনা রইল।
রেফারেন্স হিসেবে দেখতে পারেন:
১. গুগলে সার্চ দিন ‘Dark matter’
২. অথবা উইকিপিডিয়ার এই লিংকে দেখুন: https://en.wikipedia.org/wiki/Dark_matter…