ধর্মপদের দুটো গাথা আমার খুব প্রিয়। এখন তো মায়ানমারে এসে আমার কোনো ধর্মদেশনা দিতে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে থাকতে যেখানেই যেতাম আমাকে মাইক্রোফোন হাতে নিতে হতো। ধর্মদেশনা দিতে দিতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আমি নিজেই বুঝি না, অন্যকে বুঝাবো কী? প্রায় সময়ই এরকম হয়, অতর্কিতে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হলো। ধর্মদেশনার পালা পড়লো আমার ভাগে। কিছুই জানি না, কিছুই পারি না। কী বলব? কয়েকবার এমন হওয়াতে এরপর থেকে ধর্মপদের দুটো গাথা ভালোমতো মুখস্থ করে রেখেছি। তখন থেকে হঠাৎ করে কেউ ধর্মদেশনার কথা বললে শুধু ঐ গাথাগুলো চালিয়ে দিই। গাথাগুলো অবশ্য আমারও খুব পছন্দের। তাই এখানেও সেদুটোর ব্যাপারে একটু লিখতে ইচ্ছে হলো।
দুটোর মধ্যে প্রথম গাথায় পাপের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো পাপ করে তাহলে সে যেন তা আর বার বার না করে, তাতে যেন সে উৎসাহ না জন্মায়। কারণ পাপের সঞ্চয় দুঃখকর (ধর্মপদ.১১৭)।
আবার এরপরের গাথায় পুণ্যের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো পুণ্য করে, তাহলে সে যেন তা বার বার করে। তাতে যেন সে উৎসাহ জন্মায়। কারণ পুণ্যের সঞ্চয় সুখকর (ধর্মপদ.১১৮)।
এই গাথাগুলোর সুন্দর ব্যাখ্যা আছে, দীর্ঘ মনোমুগ্ধকর কাহিনী আছে। আমি সেগুলোতে যাব না। দৈনন্দিন জীবনে এর আচরণ করলে কী হয় সেব্যাপারেও আমি ব্যাখ্যা করতে পারি। কিন্তু আমি সেটাও বলব না। আমি শুধু একটা জিনিস বলব, বুদ্ধ এই যে এখানে পাপ ও পুণ্যের কথা বলেছেন সেটার উৎস কোথায়? কোত্থেকে এলো পাপ পুণ্য? সমাজে নিশ্চয়ই বুদ্ধের আগে থেকেই পাপ ও পুণ্যের কথা প্রচলিত ছিল। তিনি কি সমাজের সেই প্রচলিত রীতিটাই গ্রহণ করেছেন? নাকি নিজের বুদ্ধজ্ঞানে জেনে বুঝে তবেই সেরকম বলেছেন?
আমরা এর জন্য তার বুদ্ধত্ব লাভের বিবরণগুলো দেখতে পারি। বুদ্ধ নিজেই বিভিন্নজনের কাছে তার বুদ্ধত্ব লাভের বর্ণনা দিয়েছিলেন। বোধিবৃক্ষের নিচে বসে তিনি কীভাবে ধ্যান লাভ করেছেন, কীভাবে নিজের পূর্বজন্মগুলো দেখেছেন, অন্য প্রাণিরা মরে গিয়ে কীভাবে এক জন্ম থেকে আরেক জন্মে বিভিন্ন কুলে জন্ম নিচ্ছে সেগুলো কীভাবে দেখেছেন, কীভাবে ক্লেশ ক্ষয় করে অর্হৎ হয়েছেন সবই তিনি সুন্দরভাবে বর্ণনা দিয়েছেন বিভিন্ন সুত্রে। উদাহরণস্বরূপ তিনি বেরঞ্জ ব্রাহ্মণের অভিযোগের জবাবে সেভাবে বলেছিলেন (পারাজিকা=> বেরঞ্জকাণ্ড)। বোধিরাজকুমারকেও তিনি সেভাবে বলেছিলেন (মধ্যম নিকায়.২.৩২৪)। আরো অন্যান্য বহু সুত্রে তার এমন বুদ্ধত্ব লাভের কথা আছে।
বুদ্ধের সেই বিবরণ থেকে আমরা দেখি যে, তিনি প্রথমে ধ্যানমগ্ন হয়ে চতুর্থধ্যান পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এই চতুর্থ ধ্যানে মনটা খুব একাগ্র হয়, প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়। যে বিষয়েই জানতে ইচ্ছে করে সেই বিষয়টাকে মন তখন লেজারের মতো ভেদ করে ফেলে। এমন শক্তিশালী মন তখন পূর্বজন্মগুলো দেখার মতো উপযোগী হয়। (পাঅক ভাবনাকেন্দ্রের ভাবনাকারীদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, ধ্যানে মন একাগ্র হলে তা শক্তিশালী আলো উৎপন্ন করে। সেই আলোতে পূর্বজন্ম দেখার কাজটা সহজ হয়। ধ্যানের আলো না থাকলে তখন শুধু অন্ধকার দেখা যায়। তাই পূর্বজন্মগুলো দেখার জন্য ধ্যান লাভ করাটা জরুরী।)
এভাবে মনটাকে প্রস্তুত করে বুদ্ধ তখন তার পূর্বজন্মগুলো দেখতে লাগলেন একটা একটা করে। এক জন্ম, দুই জন্ম এভাবে লক্ষ লক্ষ জন্মকে তিনি দেখলেন। অতীতে অসংখ্যবার পৃথিবী ধ্বংস হয়েছে, আবার নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। আবার নতুন করে শুরু হয়েছে সবকিছু। এভাবে অসংখ্যবার পৃথিবী সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংসের সময়ে তিনি কোথায় কোথায় জন্মেছিলেন সেগুলো সবই দেখলেন। তার চেহারা কেমন ছিল, বাবামা কে কে ছিল, কোন বংশে জন্মেছিলেন, কয় বছর বেঁচেছিলেন সবই দেখলেন। সেই জন্ম থেকে মরে গিয়ে কোথায় জন্মালেন সেটাও দেখলেন। এভাবে তিনি নিজের পূর্বজন্মগুলো সম্পর্কে জেনে নিলেন।
এরপর তিনি সেই ধ্যানের আলোয় বিশুদ্ধ দিব্যচোখে দেখলেন কোন প্রাণি মরে কোথায় জন্মাচ্ছে। তিনি দেখলেন বহু প্রাণি খারাপ কাজ করেছে, খারাপ কথা বলেছে, খারাপ হিংসুটে মন নিয়ে আছে, আর্যদেরকে নিন্দা করেছে, মিথ্যা ধারণা নিয়ে আছে। তারা মৃত্যুর পরে দুর্গতিতে যাচ্ছে, নরকে, প্রেতকুলে অথবা পশুপাখি বা কীটপতঙ্গ হিসেবে জন্মাচ্ছে। তাই বুদ্ধ বললেন সেই কাজগুলো হচ্ছে অসাধু। সেগুলো অনার্য ধর্ম। সেগুলো অকুশল। সেগুলো পাপ। (অঙ্গুত্তর নিকায়.১০ নিপাত. সাধুবর্গ)
আবার তিনি দেখলেন বহু প্রাণি ভালো কাজ করেছে, সত্য কথা বলেছে, খারাপ হিংসুটে মনমানসিকতা নিয়ে থাকে নি। তারা মৃত্যুর পরে সুগতিতে যাচ্ছে, স্বর্গে অথবা মানুষ হিসেবে জন্মাচ্ছে। তাই বুদ্ধ সেই কাজগুলোকে বললেন সাধু। সেগুলো আর্যধর্ম। সেগুলো কুশল। সেগুলো পুণ্য। (অঙ্গুত্তর নিকায়.১০ নিপাত. সাধুবর্গ)
এভাবেই বুদ্ধ স্বয়ং দেখে ও বুঝে আমাদেরকে বলে দিয়েছেন- পাপ যদি কোনোমতে করাও হয়ে যায় তাহলে সেটা যেন আর করার ইচ্ছা না হয়। সেটা যেন আর স্মরণও না করা হয়। কারণ পাপ পরিণামে দুঃখই বয়ে আনে। আর পুণ্য যদি কোনোমতে করাও হয়ে যায়, তাহলে সেটা যেন বার বার করার ইচ্ছা করা হয়। সেটা যেন বার বার স্মরণ করা হয়। কারণ পুণ্যের পরিণামে সুখই বয়ে আনে।
তাই আসুন আমরা দুঃখদায়ক কর্মগুলোকে বর্জন করার চেষ্টা করি। বুদ্ধের নির্দেশিত সুখদায়ক কর্মগুলোকেই বারবার করার চেষ্টা করি। আমাদের সবার জীবনে সুখ আসুক।