অশোক রাজার সময়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুর বেশধারী ৬০,০০০ ব্রাহ্মণ ও তির্থীয় সন্ন্যাসীকে ধরে ধরে গৃহী বানিয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা তখন পাটলিপুত্র থেকে বের হয়ে রাজগৃহের নালন্দায় গিয়ে মিলিত হলো। সেখানে তারা ষড়যন্ত্র করল, ‘লোকজন যাতে বুদ্ধশাসনে যেতে না পারে, তার জন্য শাক্যদের ধর্মবিনয়কে নাশ করতে হবে। কিন্তু তাদের মতবাদ না জানলে তো তা সম্ভব নয়। কাজেই যেকোনো উপায়ে আবার তাদের কাছে প্রব্রজ্যা নিতে হবে।’ এই সিদ্ধান্ত মোতাবেক তারা আবার থেরবাদীদের কাছে প্রব্রজ্যা চাইল। কিন্তু থেরবাদীরা তাদেরকে বুদ্ধশাসনে জায়গা দিল না। তখন তারা মরিয়া হয়ে অন্যান্য সতেরটি মহাসাঙ্ঘিক নিকায়গুলোর মধ্যে গিয়ে ভুয়া পরিচয়ে প্রব্রজ্যা নিল। তারা সেখানে ভালোমতো ত্রিপিটক শিক্ষা করল। ত্রিপিটককে জানার পরে এবার তারা সেটাকে সুকৌশলে বিকৃত করার পরিকল্পনা করল।
এরজন্য তারা এবার কৌশাম্বি শহরে গিয়ে একত্রিত হলো। সেখানে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এরপর তারা সেখান থেকে ছয়টি স্থানে ছড়িয়ে গেল। সেই ছয়টি স্থান থেকে তারা নতুন নয়টি নিকায়ের জন্ম দিল। তাদের নাম ও ধর্মমতগুলো কথাবত্থু অর্থকথায় আলোচিত হয়েছে।
তারা ত্রিপিটককে নকল করে বর্ণপিটক, অঙ্গুলিমাল পিটক, গুহ্যবেস্সন্তর, রাষ্ট্রপাল গর্জন, আলবক গর্জন, গুহ্যবিনয় নামক গ্রন্থ রচনা করে সেগুলোকে বুদ্ধভাষিত হিসেবে প্রচার করতে লাগল। তারা মায়াজালতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি অনেকগুলো তন্ত্রগ্রন্থ এবং মরীচিকপ্প, হেরম্ভকপ্প ইত্যাদি কপ্পগ্রন্থ রচনা করল। এছাড়াও বৈতুল্যপিটক, রত্নকূট, অক্ষরসার ইত্যাদি গ্রন্থ তারা রচনা করল। আচার্য অসঙ্গ ছিলেন মহাসাঙ্ঘিকদের অন্যতম বিখ্যাত স্থবির। তিনি তার অভিধর্ম সমুচ্চয় নামক গ্রন্থে বৈতুল্যপিটককে এমন সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন যে তা বুদ্ধবাণী নয় বলে দাবি করাই মুশকিল। তার অভিধর্ম সমুচ্চয় গ্রন্থে তিনি বৈতুল্যপিটককে বোধিসত্ত্বপিটক হিসেবে দেখিয়েছেন। তাই বোধিসত্ত্বপিটকে আলোচিত মহাযানীদের সদ্ধর্মপুণ্ডরীক সুত্র ইত্যাদি বিষয়গুলোও বৈতুল্যবাদের পর্যায়ে পড়ে।
শ্রীলঙ্কায় অভয়গিরি বিহারের ভিক্ষুরা মহাসাঙ্ঘিকদের মতবাদগুলোকে গ্রহণ করেছিল। তারা এই বৈতুল্যবাদও অধ্যয়ন করত। এই বৈতুল্যবাদীদের কয়েকটা যুক্তি হচ্ছে এরকম:
১) পারমার্থিকভাবে মার্গফলগুলোই হচ্ছে সঙ্ঘ। মার্গফল কোনোকিছু গ্রহণ করতে পারে না, দিতেও পারে না। তাই তাদেরকে দান দিলে কোনো উপকারই হয় না। তাই সঙ্ঘকে দান দিলে মহাফল হয় বলাটা ঠিক নয়।
২) বুদ্ধ ভগবান কোনো কিছু খান না। কেবল জগতের অনুকরণে খাচ্ছেন বলে নিজেকে দেখান। যেহেতু এতে কোনো উপকার হয় না, তাই বুদ্ধকে দান দিলে মহাফল হয় বলাটা ঠিক নয়।
৩) ভগবান বুদ্ধ তুষিতস্বর্গে জন্ম নিয়ে সেখানেই বসবাস করেন। তিনি সশরীরে মনুষ্যলোকে আসেন না। এখানে কেবল তার প্রতিমূর্তিকে দেখান।
৪) তুষিতস্বর্গ থেকে বুদ্ধ ধর্মদেশনার জন্য তার নির্মিতরূপকে প্রেরণ করেন। তার দেশনা শুনে আনন্দ ভান্তেই সেটা অন্যদেরকে বলে দিয়েছেন। তাই আনন্দ ভান্তে কর্তৃক ধর্ম দেশিত হয়েছে। সেটা ভগবান বুদ্ধের নয়।
৫) ভিক্ষুদের যৌনমিলন নিষিদ্ধ। তবে দুজনের একই ইচ্ছা থাকলে তখন কিন্তু যৌনমিলন করতে পারে। অর্থাৎ কারোর প্রতি করুণাবশত অথবা সংসারে তো একা হয়ে যাব এই ভেবে কোনো নারীর সাথে বুদ্ধপূজা ইত্যাদি করে দুজনেরই যদি ইচ্ছা হয় তাহলে যৌনমিলন করা যায়।
অভয়গিরি বিহারের ভিক্ষুরা এগুলোকে বুদ্ধভাষিত বলে প্রচার করতে লাগল। কিন্তু মহাবিহারবাসী স্থবিরগণ সেগুলো বুদ্ধভাষিত নয় বলে প্রতিবাদ জানালেন। তখন শ্রীলঙ্কায় রাজা ছিলেন গোঠাভয়। তিনি অন্যান্য স্থানের ভিক্ষুদের থেকে ব্যাপারটা অনুসন্ধান করে বৈতুল্যবাদকে অবুদ্ধভাষিত বলে বুঝতে পারলেন। এরপর সেই মতবাদী ৬০জন পাপীভিক্ষুকে মার্কা দিয়ে চিহ্নিত করে রাষ্ট্র থেকে বের করে দিলেন। বৈতুল্যবাদী পুস্তকগুলোও পুড়িয়ে দিলেন।
শ্রীলঙ্কা থেকে নির্বাসিত সেই ভিক্ষুদের কেউ কেউ দক্ষিণ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিল। দক্ষিণ ভারতে তাদের কাছে প্রব্রজ্যা নিতে এলো অন্যতির্থীয় এক তরুণ সন্ন্যাসী। ভিক্ষু হয়ে তার নাম রাখা হলো সঙ্ঘমিত্র। যখন সে জানল যে মহাবিহারবাসীদের কারণেই রাজা এই ভিক্ষুদেরকে রাজ্যছাড়া করেছেন তখন সে প্রতিজ্ঞা করল, ‘তাদেরকে আমি বৈতুল্যবাদ গ্রহণ করিয়ে ছাড়ব, নতুবা তাদের বিহার নির্মূল করে বিনাশ করব।’ এই সংকল্প নিয়ে সে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে কৌশলে রাজাকে খুশি করে দুই রাজকুমারকে শিল্পবিদ্যা শিক্ষা দিতে আরম্ভ করল।
দুই রাজকুমারের মধ্যে বড়টার নাম ছিল জ্যৈষ্ঠতিষ্য। তাকে দলে ভেড়াতে পারল না। ছোটটার নাম ছিল মহাসেন। তাকে ভুলানো সহজ হলো। পরবর্তীতে মহাসেন রাজা হয়ে সিংহাসনে বসলে তখন এই সঙ্ঘমিত্র ভিক্ষুটি অভয়গিরি থেকে নানান ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল যাতে মহাবিহারবাসীরা বৈতুল্যবাদকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু মহাবিহারবাসীরা ত্রিপিটকের সাথে অন্যকিছু মিশতে দিতে চাইল না। তাতে ব্যর্থ হয়ে সঙ্ঘমিত্র তখন রাজার কাছে গিয়ে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে একটা আদেশ জারি করাল, ‘মহাবিহারবাসী একটা ভিক্ষুকেও যে আহার দেবে তার একশ মুদ্রা জরিমানা।’
মহাবিহারবাসী ভিক্ষুরা তিনদিন ধরে ভিক্ষা না পেয়ে একত্রিত হয়ে পরামর্শ করল, ‘আমরা যদি ক্ষুধার কারণে অধর্মকে ধর্ম বলে গ্রহণ করি, তাহলে বহুজন তা গ্রহণ করে নরকগামী হবে, দুর্গতিগামী হবে। আমরাও সবাই দোষণীয় হবো। তাই জীবন থাকতে আমরা এই বৈতুল্যবাদকে গ্রহণ করব না।’ এভাবে পরামর্শ করে তখন তারা মহাবিহার ছেড়ে রোহণ ও মলয় অঞ্চলের বিভিন্ন বিহারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেল। তখন সঙ্ঘমিত্র রাজাকে খবর দিয়ে মহাবিহারের তিনশ চৌষট্টিটিরও অধিক কুটির, বিহার ও প্রাসাদ ধ্বংস করে ভিত্তিসহ সমূলে উপড়ে দিল। বিহারের জায়গাটিতে হালচাষ করে সবজি রোপণ করাল। এভাবে তখন মহাবিহার ধ্বংসস্তুপে পরিণত হলো।
নয়বছর পরে এক মন্ত্রী তখন রাজাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মহাবিহারের ধ্বংসস্তুপকে সংস্কার করে আবার স্বাভাবিক চেহারায় ফিরিয়ে আনলেন এবং চলে যাওয়া ভিক্ষুদেরকে ডেকে এনে ভিক্ষান্ন ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়ে সেবা করলেন।
বুদ্ধশাসনের ইতিহাস-১ম পর্ব – ভারতে বৌদ্ধধর্ম
বুদ্ধশাসনের ইতিহাস – ২য় পর্ব – শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্ম
বুদ্ধশাসনের ইতিহাস – ৩য় পর্ব – অধর্মবাদীদের উৎপত্তি
বুদ্ধশাসনের ইতিহাস – ৪র্থ পর্ব – অভয়গিরি বিহারের উত্থান পতন
রেফারেন্স:
১. বিশুদ্ধিমার্গ নিদান কথা
২. কথাবত্থু অর্থকথা
৩. উইকিপিডিয়া