বিদ্যাধরদের সপক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে ফেসবুকের অনেক পেজে খুব বড় বড় লেখা লিখে রেখেছে গুরুবাদীরা। প্রয়োজনমতো সেগুলো দিয়ে তারা নিরীহ লোকজনকে বুঝায়। আর লোকজনও মনে হয় তাতেই বুঝ পায়। কিন্তু বুদ্ধ বলেছেন, কারো কথা বিশ্বাস করার আগে বিনয় ও সুত্রের সাথে একটু মিলিয়ে দেখতে। তাই আসুন আমরা তাদের কথাগুলো একটু ত্রিপিটকের সাথে মিলিয়ে দেখি। তাদের কথাগুলো হচ্ছে এরকম:
———————————————–
★বিদ্যা ও বিদ্যাধর এবং মার্গফলপ্রাপ্ত আর্যগুরুগণের দীক্ষা সম্পর্কিত ত্রিপিটকীয় সত্যতা যাচাই ও ব্যাখ্যা–★★★
★সম্যক দৃষ্টির দশবস্তুতে বলা হয়েছে যে, এই মনুষ্যলোকে শীল সমাধিতে সম্যকভাবে প্রতিষ্ঠিত এমন শ্রমণ- ব্রাহ্মণ আছেন যারা ইহলোক ও পরলোক স্বয়ং অভিজ্ঞান দ্বারা দর্শন করেছেন তাদেরকে বলা হয় বিদ্যাধর। এমন বিদ্যা ও বিদ্যাধর ৫ প্রকার। যথাঃ
১) বেদ বিদ্যা ও বেদ বিদ্যাধর,
২) মন্ত্র বিদ্যা ও মন্ত্র বিধ্যাধর
৩) গন্ধারী বিদ্যা ও গন্ধারী বিদ্যাধর
৪) লোকীয় বিদ্যা ও লোকীয় বিদ্যাধর এবং
৫) আর্য বিদ্যা ও আর্য বিদ্যাধর।
——————————————————–
তাদের ব্যাখ্যার প্রথমেই “সম্যকদৃষ্টি দশবস্তু”র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে নাকি আছে, “এই মনুষ্যলোকে শীল সমাধিতে সম্যকভাবে প্রতিষ্ঠিত এমন শ্রমণ- ব্রাহ্মণ আছেন যারা ইহলোক ও পরলোক স্বয়ং অভিজ্ঞান দ্বারা দর্শন করেছেন তাদেরকে বলা হয় বিদ্যাধর।” কী সুন্দর কথা, তাই না? দেখি ত্রিপিটক কী বলে।
সম্যকদৃষ্টির দশবস্তুর ব্যাপারে ত্রিপিটকের বহু সুত্র আছে। আমরা মধ্যম নিকায়ের সালেয়্যক সুত্রে দেখি, “সম্মাদিট্ঠিকো খো পন হোতি অৰিপরীতদস্সনো – ‘অত্থি দিন্নং অত্থি যিট্ঠং অত্থি হুতং, অত্থি সুকতদুক্কটানং কম্মানং ফলং ৰিপাকো, অত্থি অযং লোকো অত্থি পরো লোকো, অত্থি মাতা অত্থি পিতা, অত্থি সত্তা ওপপাতিকা, অত্থি লোকে সমণব্রাহ্মণা সম্মগ্গতা সম্মাপটিপন্না যে ইমঞ্চ লোকং পরঞ্চ লোকং সযং অভিঞ্ঞা সচ্ছিকত্বা পৰেদেন্তী”।
অর্থকথা অনুসারে এর অনুবাদ করলে দাঁড়ায়- “সম্যকদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি হয় যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন – অর্থাৎ (সে দেখে) দানের ফল আছে, মহাদানের ফল আছে, সেবাপূজার ফল আছে, ভালোকর্ম-খারাপ কর্মের ফল আছে, ইঽলোক আছে পরলোক আছে, মা-বাবা আছে (অর্থাৎ মা-বাবাকে সেবাপূজার ফল আছে), মৃত্যুর পরে জন্মগ্রহণকারী সত্ত্ব আছে। জগতে শ্রমণ ব্রাহ্মণ আছেন যারা সম্যকগত, সম্যক আচরণকারী, যারা ইহলোক ও পরলোককে স্বয়ং উচ্চতর জ্ঞানে প্রত্যক্ষ করে তা প্রকাশ করে থাকেন।” অর্থকথামতে, এই সর্বশেষ কথাটা সর্বজ্ঞ বুদ্ধকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে।
কিন্তু এবার দেখুন সর্বশেষ কথাটিকে বিকৃত করে ওরা কী লিখেছে। সেখানে তারা লিখেছে, “এই মনুষ্যলোকে শীল সমাধিতে সম্যকভাবে প্রতিষ্ঠিত এমন শ্রমণ- ব্রাহ্মণ আছেন যারা ইহলোক ও পরলোক স্বয়ং অভিজ্ঞান দ্বারা দর্শন করেছেন তাদেরকে বলা হয় বিদ্যাধর।” তারা বিদ্যাধরকে বুদ্ধের স্থানে বসিয়ে দিয়েছে! বিদ্যাধরদের কাজকে বৈধতা দেয়ার জন্য তারা কীরকম মনগড়া ব্যাখ্যা দিতে পারে আমি পড়ে অবাক হয়ে যাই।
এরপরে তারা বিদ্যা ও বিদ্যাধরদের একটা শ্রেণিবিভাগ দিয়ে দিয়েছে। এধরনের শ্রেণিবিভাগ ত্রিপিটকে আপনি কোথাও খুঁজে পাবেন না। শুধুমাত্র তাদের বইপত্রে দেখা মিলবে।
প্রথমে লিখেছে বেদবিদ্যা ও মন্ত্রবিদ্যার কথা। এসব বিদ্যায় পারদর্শী কয়েকজন ব্রাহ্মণের কথাও লিখেছে। সেই ব্রাহ্মণগণ নাকি জনগণ ও রাজাগণ কর্তৃক পূজিত হতেন, এবং বহু ধনসম্পত্তির মালিক ছিলেন। আকাশে বাতাসে বিচরণ করতে পারতেন। ভালো কথা। ভিক্ষু হয়েছেন কি জনগণ ও রাজা কর্তৃক পূজিত হওয়ার জন্য? আকাশে বাতাসে বিচরণ করার জন্য?
এরপরে গান্ধারী বিদ্যার কথা বলেছে। দেখলাম শুধু টীকা থেকে একটা বাক্য উল্লেখ করেছে নিজেদের বৈধতা দেয়ার জন্য। এরপর টীকার সংজ্ঞাকে ওরা পাশ কাটিয়ে গিয়ে বাকিটুকু নিজেদের খেয়াল খুশিমতো বসিয়ে দিয়েছে। তাদের মতে “চূলগান্ধারী বিদ্যাধর হচ্ছে নিজস্বলব্ধ ধ্যান ও অভিজ্ঞান বল ও ঋদ্ধিতে সন্তুষ্ট ও তৃপ্ত থেকে লৌকিক বলয়ের মধ্যে বিচরণ করেন। তাঁরা সমথ ভাবনায় সীমাবদ্ধ থাকেন বিধায় লৌকিক ধ্যান ও অলৌকিক শক্তি প্রাপ্ত হলে লোকোত্তর প্রজ্ঞা বা বিদর্শন জ্ঞানের অধিকারী হতে পারেন না। তাঁদের বিদ্যাকে বলা হয় চুল গন্ধারী বিদ্যা।”
অথচ টীকায় বলা হয়েছে, তিন বছরের মধ্যে মারা গেছে এমন সত্ত্বরা কে কোথায় উৎপন্ন হয়েছে তা জানাটাই হচ্ছে চূলগান্ধারীবিদ্যা। টীকার কথা আর ওদের কথার কতটুকু তফাত দেখুন তো।
মহাগান্ধারী সম্পর্কে ওরা বলে, “যে সকল চুল গন্ধারী বিদ্যাধর শুধু সমথ ভাবনায় সীমাবদ্ধ না থেকে বিদর্শন ভাবনার মাধ্যমে চতুরার্য্য সত্যকে প্রত্যক্ষ ও উপলব্ধিক্রমে লোকোত্তর প্রজ্ঞার অধিকারী হয় তাঁদেরকে মহাগন্ধারী বিদ্যাধর বলা হয় এবং তাঁদের বিদ্যাকে মহাগন্ধারী বিদ্যা বলে।” পড়লে কত যৌক্তিক মনে হয়, তাই না?
কিন্তু টীকামতে, মহাগান্ধারীবিদ্যা সেরকম নয়। মহাগান্ধারী বিদ্যা হচ্ছে চূলগান্ধারীর মতোই বিদ্যা যেটা দিয়ে মৃত্যুর খবর তো জানা যায়ই, সেটা বাদেও মন্ত্র জপ করে বহুধরনের অলৌকিক ঘটনা দেখানো যায়। সেই মহাগান্ধারী বিদ্যাধর সাধক মন্ত্র জপ করে একজন থেকে বহুজন হয়, বহুজন হয়ে একজন হয়; হাতি ঘোড়া ইত্যাদি দেখায়, অগ্নিস্তম্ভ সৃষ্টি করায়, জলস্তম্ভ সৃষ্টি করায়, আকাশে নিজেকে দৃশ্যমান করায়। এই সবই ইন্দ্রজাল বা মায়াবিদ্যা হিসেবে দেখতে হবে।
ওরা সাফাই গেয়ে কত কী লিখেছে। আমার আর অত কিছু পড়তে ইচ্ছে করছে না।
ও হ্যাঁ, বৈদ্যালীর ব্যাপারে বলি। পারাজিকা ৩ এর অর্থকথা বলে যে, “তস্মা আগতাগতস্স পরজনস্স ভেসজ্জং ন কাতব্বং, করোন্তো দুক্কটং আপজ্জতি। ” অর্থাৎ অনাত্মীয় লোকজন ওষধ বা চিকিৎসার জন্য ভিক্ষুর কাছে আসলেও ওষধ দেয়া উচিত নয়, চিকিৎসা করা উচিত নয়। করলে দুক্কট আপত্তি হয়। তবে পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজন, নিজের সেবক, বিহারের সেবক হলে তাদেরকে চিকিৎসা করা যায়। ভিক্ষু, শ্রমণকে তো করা যায়ই। কাজেই বৈদ্যালী ও চিকিৎসা করার ব্যাপারেও ভিক্ষুদের সাবধান থাকা ভালো। এমনকি পানি ছুঁইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রেও বিনয়গারবীরা খুব সতর্ক থাকেন।